কার্তিক সংক্রান্তি। এ-দিন ইতু দেবীর আসন পাতার দিন। সদর থেকে গোবর নিকনো উঠোন বেয়ে সাদা খড়ি-পিটুলিতে লতা-পাতা লক্ষ্মীপায়ের ছাপ আঁকা আলপনা চলে গেছে কীর্ণ পথের রেখার মতো তুলসী মঞ্চের তলা অব্দি। সেখানেও চৌকো ছাঁদের আলপনায় আঁকা ব্রতিনীর বসার আসন, গোলছাঁদে ফুল ও লক্ষ্মীর ঝাঁপি আঁকা আলপনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ঘট-মালসা স্থাপনের আসন। এই তুলসীতলাতেই প্রথম পাতা হবে দেবীর ঘট-মালসা। দেবীর কোন প্রতিমা পুজোর বিধি নেই। প্রতিমা নেইও। মাটির ঘট-মালসার প্রতীকে তিনি পূজিতা হন। ঘট ও মালসা সাজানোর উপকরণের হেরফের ঘটে স্থান-বিশেষে। বাঁকুড়ার বিভিন্ন অঞ্চলেও এই ফারাক চোখে পড়ে। সাধারণত মালসায় মাটি দিয়ে তাতে পাঁচ রকমের কলাই, কচু, মান, হলুদ গাছ, ধানের ছড়া প্রভৃতি ফসলের বীজ বপন ও রোপণ করা হয়। মালসার গায়ে সিঁদুর দিয়ে চারপাশে আঁকা থাকে স্বস্তিক চিহ্ন। ঘটে থাকে জল। কোথাও মালসায় শুধু কলাই বপন করা হয়, আর ঘটের জলে রাখা হয় পাকাধানের ছড়া, দুব্বো ঘাস, আখ, বেলপাতা প্রভৃতি।
কার্তিকের সংক্রান্তি থেকে অঘ্রানের সংক্রান্তি এই এক মাস ধরে চলবে ইতু দেবীর ব্রত। এই ব্রত করেন মূলত এয়ো ও কুমারী মেয়েরা। তুলসীতলায় প্রথম ঘট ও মালসা পাতার পর তারা তা তুলে রাখেন ঘরের ভেতর। ঘরের ভেতর আলপনারঞ্জিত থানে ঠাঁই হয় দেবীর। এই ব্রতে রবিবার গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ-দিন ব্রতিনীরা স্নান করে শুদ্ধভাবে সরায় জল ঢেলে ব্রত উদযাপন করেন। মন্ত্র পড়েনঃ
‘অষ্ট চাল অষ্ট দুব্বা কলসপাত্রে থুয়ে।
শুন একমনে ইতুর কথা সবে এক হয়ে।।...’
এভাবে কেটে যায় একটা মাস। তারপর আসে অঘ্রানের সংক্রান্তি। সেদিন কাকভোরে স্নান করে দেবীকে ভোগ দিয়ে পুজো করে ব্রতিনী ঘট ও মালসা নিকটের নদী বা পুকুরে বিসর্জন দিয়ে আসেন। তারপর নিজে উপোষী থেকে আরেক উপোষীকে দেবীর ব্রতকথা শোনান; তারপর উভয়ে উপোষ ভঙ্গ করেন।
ইতু দেবীর ব্রতকথার কাহিনি একটু জটিল। তাকে সহজ করে সংক্ষেপে বলছিঃ
বামুন ও বামনির দুই মেয়ে উমনো আর ঝুমনো। উমনো একটু বোকাসোকা, কিন্তু ঝুমনো বেশ চালাকচতুর। বামুন বেজায় গরীব। তবে খেতে খুব ভালোবাসে। বামনি একদিন চেয়েচিন্তে চাল জুটিয়ে তা দিয়ে বামুনের জন্য পিঠে বানাল। কিন্তু দুই মেয়ে তো ভালোমন্দ কখনও কিছু খেতে পায় না। তারা একটা একটা করে খেতে খেতে নিজেদের সামলাতে না-পেরে সব পিঠে খেয়ে ফেলল। বামুন একটাও পিঠে খেতে পেল না। মেয়েদের উপর তার ভারি রাগ হল। এমন মেয়েদের বাড়িতে আর রাখবে না ঠিক করে তাদের মিছিমিছি মামার বাড়ি নিয়ে যাবে বলে পথে বেরুল। সেই পথ বেয়ে একটা বনে গিয়ে হাজির হল। মেয়েরা অনেক পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা এক সময় আর হাঁটতে না পেরে গাছের ছায়ায় শুয়ে বনের ঝিরিঝিরি বাতাসে ঘুমিয়ে পড়ল। এই সুযোগে বামুন তাদের সেখানে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল।
ঘুম ভাঙতেই বাবাকে না-দেখতে পেয়ে প্রথমে তারা খুব কাঁদল। তারপর ঝুমনো খানিক বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝল যে, বাবা তাদের ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিয়ে গেছে। ভেবে ঠিক করল, বাঁচতে হলে আগে এই বন থেকে বেরুবার চেষ্টা করতে হবে। তখন সে উমনোকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকালয় খুঁজতে খুঁজতে একসময় বনের শেষে একটা পুকুরপাড়ে হাজির হল। দেখল, সেই পুকুরে বেশ কিছু মেয়ে স্নান করে ঘট পেতে কীসের যেন পুজো করার আয়োজন করছে। জিজ্ঞেস করে জানল, তারা ইতু দেবীর ঘট পাতছে ব্রত করবে বলে। দেবীর ব্রত করলে কী হয়? ধন হয়, সম্পদ হয়, সৌভাগ্য ফেরে। তারা ভাবল, তারাও এই ব্রত করবে। কিন্তু তারা এমনই হতভাগিনী যে, পুকুরে স্নান করতে যেই নামল, অমনি পুকুরের জল শুকিয়ে গেল। তাতে মনখারাপ করে তারা খুব কান্নাকাটি শুরু করল। তাতে দেবী কৃপা করে বুড়ি বামনির বেশ ধরে এসে তাদের সাহায্য করলেন। ঘটের দুব্বো পুকুরে ফেলতে পুকুর আবার জলে ভরল। তখন তারা স্নান করে দেবীর দেখানো পথে ব্রত সম্পন্ন করল। এবার দেবী তাদের সামনে এসে বর দিলেন। সেই বরে তারা বাবামাকে ফিরে পেল। বাপমায়ের অতুল ঐশ্বর্য হল। দুই বোনেরও সৌভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল।
একদিন এক রাজ্যের রাজপুত্র ও কোটালপুত্র খুব তেষ্টায় ঘুরতে ঘুরতে তাদের বাড়ি এল। তখন ব্রতের ঘটের জল তাদের খেতে দিল দুই বোন। সেই ছোট্ট ঘটের জল রাজপুত্র, কোটালপুত্র এবং তাদের লোকলস্কর সকলে খেল, তবু জল শেষ হল না। তাই দেখে সকলের তাক লেগে গেল। রাজপুত্র ও কোটালপুত্র বেশ আশ্চর্য হয়ে দুই বোনকে বিয়ে করতে চাইল। অমনি বামুনবামনি যেন হাতে চাঁদ পেল! ব্যস, শুভদিনে উমনোর সঙ্গে রাজপুত্রের, আর ঝুমনোর সঙ্গে কোটালপুত্রের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর উমনো রাজবাড়ির বউ হবার অহংকারে ব্রত ভেঙে ফেলল, তাতে দেবী তার ওপর খুব রেগে গেলেন। সে যেখানে যেখানে যেতে লাগল, সেখানে সেখানে অলক্ষুণে ব্যাপার ঘটতে লাগল। তার এই অশুভ লক্ষণ দেখে রাজপুত্র রেগে তাকে হত্যার আদেশ দিয়ে দিল। ওদিকে ঝুমনো কিন্তু ব্রত আরও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে লাগল। তাতে সে যেখানে যেখানে যেতে লাগল, সেখানে সেখানে শুভ ঘটনা ঘটতে লাগল। সে যখন উমনোর হত্যার আদেশ শুনল, বুঝল যে ইতু দেবীর কোপেই এসব হচ্ছে। তখন সে উমনোকে জহ্লাদের হাত থেকে রক্ষা করে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখল এবং নিষ্ঠা ভরে তাকেও ব্রতপালন করাতে শুরু করল। তখন দেবী আবার প্রসন্ন হলেন। তখন রাজবাড়িতেও শুভ ঘটনা ঘটতে লাগল। দেবী রাজপুত্রকে স্বপ্নে জানালেন যে, উমনো তাঁর কৃপায় বেঁচে আছে, ঝুমনোর সহায়তায় তাকে যেন সে গ্রহণ করে। দেবীর আদেশ পেয়ে রাজপুত্র ঝুমনোর কাছে লোক পাঠালেন। তখন ঝুমনো গোপনে রাজপুত্রের সঙ্গে উমনোর মিলন ঘটিয়ে দিল। তারপর ব্রত সমাপন করে ব্রতকথা ও দেবীর মাহাত্ম্যগাথা শোনার মধ্য দিয়ে সকলের মঙ্গল হল।
আসলে, ইতু হলেন পৌরাণিকতার পথ বেয়ে গড়ে ওঠা এক লৌকিক দেবী। বাংলা তথা বাঁকুড়ার লৌকিক ব্রতের ধারায় তিনি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। প্রথমেই ইতুর যে পুরাণ যোগের কথা বললাম, সেটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ইতু দেবীর উদ্ভবের ইতিহাসে আমরা দেখি যে, তিনি দুই দেবতা ও এক দেবীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছেন। এই দুই দেবতা হলেন ইন্দ্র ও সূর্য। আর এক দেবী হলেন, লক্ষ্মী। দেবী ইতুর উদ্ভবের সঙ্গে কৃষির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে এবং কৃষির সঙ্গে নিবিড় যোগ রয়েছে এই তিন দেবদেবীরও।
আমরা এই যে দেবী ইতুর ব্রত করি, এর মূলে আছে জাদু-সংস্কার। সেটা কেমন? আমাদের আদিম একটা বিশ্বাস রয়েছে যে, আমরা যদি কোন কিছুর ওপর দৈব রোষ বা অনুগ্রহের নকল করি; তাহলে সেটা বাস্তবে সত্যি ঘটে। এই ভাবনারই একটা খারাপ দিক আমরা দেখতে পাই ‘বাণ মারা’ নামক অনুষ্ঠানে। এতে যে মানুষ বা প্রাণির ক্ষতি করার আয়োজন করা হয়, তার নকল মূর্তি তৈরি করে বাণ মারা হয় এবং বিশ্বাস করা হয় যে, এতে সেই উদ্দিষ্ট মানুষ বা প্রাণি আহত হয়ে মারা যাবে। যদিও এসব নিতান্তই বুজরুকি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ অন্ধ-আদিমবিশ্বাসে এইসব বুজরুকিতে আস্থা রাখেন।
যাই হোক, এই আদিম জাদু-সংস্কারের একটা তুলনামূলক ভালো দিক দেখতে পাই এই ইতু ব্রতে। আর সেখানেই এই ব্রতের মূলে যে কৃষি রয়েছে সেটা স্পষ্ট হয়। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করে বলছি।
পূর্বকালে যখন চাষের জন্য বৃষ্টির জলই একমাত্র ভরসা ছিল (রুক্ষ্ম মাটির দেশ বাঁকুড়ার কোন কোন অঞ্চলে এখনও বৃষ্টির জলই চাষের একমাত্র ভরসা); রবিশস্যে জলের প্রচণ্ড টান পড়ত, কেননা এই সময় খালবিল শুকোতে শুরু করত, স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকত না। তাই এই সময় মানুষ দেবতাদের অনুগ্রহের ওপর ভরসা করতেন সবচেয়ে বেশি। বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র। আলোর দেবতা সূর্য। চাষে এই দুই দেবতার অনুগ্রহ চাই-ই চাই। প্রথমদিকে গেরস্ত চাষিরা আলাদা আলাদাভাবে এই দুই দেবতার পুজো করতেন। তারপর ফসলের ফলন যাতে ভালো হয়, সেজন্য আবার লক্ষ্মীরও পুজো করতেন।
এবার এই শাস্ত্রীয় পুজো কীভাবে জাদু-সংস্কারের দিকে এগিয়ে গেল, তার সঠিক ইতিহাস নেই। তবে আমরা একটা সম্ভাবনার কথা অনুমান করতে পারি। সেটা হল, বার বার এই তিন দেবদেবীর পুজো করেও এক সময় যখন চাহিদামতো বৃষ্টি, পর্যাপ্ত আলো আর দেদার ফসল চাষি পাচ্ছিলেন না, তখন চাষি সেই আদিম জাদু-সংস্কারকেই টোটকা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেন। এতে সূর্যের বিশেষ অবস্থানে ক্ষেতে ঘড়াকে মেঘের অনুরূপ ভূমিকায় উপরে তুলে তা থেকে বৃষ্টির মতো ধারাজল ফেলে অকালে বৃষ্টিপাত ঘটানোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন; যাতে আলোর দেবতা এভাবেই পর্যাপ্ত আলো দেন, বৃষ্টির দেবতা এভাবেই প্রয়োজনীয় বৃষ্টি দেন। এবং এই প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে রবি মরসুমের সূচনায় অর্থাৎ কার্তিকের শেষ থেকে শুরু করে পুরো অঘ্রান জুড়ে। এতে হয়তো কোনভাবে সফলতা আসে, এবং ক্রমে এটা একটা ঐতিহ্যের আকার নেয়।
এই ঐতিহ্য এবং তা আকার নেওয়ার যে দীর্ঘ সময়পট তাতে ক্রমে এই আচার পালনের ভার মেয়েদের হাতে চলে আসে। মেয়েরা ক্ষেতের আচার ঘরে নিয়ে আসেন। ঘরে একটা পোর্টেবল ক্ষেত এবং ঘড়ার প্রবর্তন করেন। মালসাতে মাটি দিয়ে তাতে শস্যের গাছ পুঁতে, বীজ বুনে তাকে ক্ষেতের ‘নকল’ করে গড়ে তোলেন। মেঘরূপী ঘড়ার ক্ষুদ্র সংস্করণ হয়ে ওঠে ঘট। সূর্যের বিশেষ অবস্থান হয়ে ওঠে বিশেষ বার অর্থাৎ রবিবার। এই বার সূর্যের নামে নামাঙ্কিত। ফলে, এই দিনে ব্রতিনী মেয়েরা ঘট থেকে মালসার শস্যে জল ঢালেন। আগে এভাবে তাঁরা জল ঢেলে রৌদ্র ও বৃষ্টির কামনা জানাতেন। এখন তাঁরা অবশ্য জানান সৌভাগ্য ও সুখের প্রার্থনা। যাই হোক, সূর্যের বিশেষ অবস্থান বিশেষ ‘বার’-এ নির্দিষ্ট যখন হয়ে উঠছে, তখনই শস্যময়ী দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক হয়ে ওঠে পাকাধানের শিষ। এবং এ-সময় মেয়েদের মাধ্যমেই দুই পুরুষ দেবতা ও লক্ষ্মীদেবীর নামমাহাত্ম্য ঘুচে গিয়ে, শুধুমাত্র তাঁরা উদ্দেশ্যে থেকে অন্য এক দেবীতে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। মেয়েরাই সেই দেবীর নাম দিলেন, ‘ইতু’।...