জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অগাধ বিশ্বাস ছিল। সেই বিশ্বাস তৈরি হওয়ার সহজ একটা ধারাও দেখতে পাওয়া যায় তাঁর বাল্যের বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায়। যার কিছুটা এসেছিল পারম্পরিক বিশ্বাসের ধারা বেয়ে, কিছুটা পিতার সূত্রে।
আসলে পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাধারণ আস্তিকতায় দৈব, অদৃষ্ট ও সাধু-সন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি আস্থাবান তো ছিলেনই, তার ওপর তাঁর জীবনেই ঘটে গিয়েছিল একটি অপূর্ব অলৌকিক ঘটনা-যা শ্রুতিসূত্রে বালক বঙ্কিমের মনেও একটা চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল।
ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, তখন যাদবচন্দ্রের বয়স সবেমাত্র আঠের বছর। সেই সময় তিনি কর্মসূত্রে উড়িষ্যায় থাকতেন। দাদার কাছে। এই সময় তাঁর কানে ফোঁড়া হয় এবং তা মারাত্মক বিষিয়ে যায়। যন্ত্রণায় তাঁর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে ওঠে। সাহেব ডাক্তার ও দিশি কবিরাজের দল হাল ছেড়ে দেন। একসময় যখন নাড়িটাড়ি কিচ্ছু পাওয়া যায় না, শ্বাস নিচ্ছেন কিনা বোঝা যায় না। তখন ঘোষণা করা হয় যে, তাঁর মৃত্যু ঘটেছে।
শোক সামলে একদা তাকে বৈতরণী নদীতে দাহের জন্য নিয়ে আসা হয়। যথাবিহিত আচারের পর তাঁকে চিতায় তুলে যেই আগুন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, অমনি সেখানে হঠাৎ এক সন্ন্যাসী উদয় হয়ে প্রচণ্ড হুঙ্কারে সমস্ত থামিয়ে দেন। তারপর চিতা থেকে যাদবচন্দ্রকে নামিয়ে অদ্ভুত শুশ্রূষায় ও মন্ত্রবলে তাঁকে বাঁচিয়ে দেন।
নতুন জীবন পেয়ে কৃতজ্ঞ যাদবচন্দ্র সেই সন্ন্যাসীকে গুরুপদে বরণ করে নেন। তাঁর উপবীত ও খড়ম পুজো করতে থাকেন। এ-সমস্ত কথা জানা যাচ্ছে যাদবচন্দ্রের আত্মজীবনী ও তাঁর নাতি শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জবানি থেকে।
ঘটনাটিকে যাদবচন্দ্র নিজে আজীবন অলৌকিক ও দৈবঘটনা বলে মনে করতেন তো বটেই, তাঁর চার পুত্র শ্যামাচরণ, সঞ্জীবচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, পূর্ণচন্দ্রও বাল্যে তাই-ই মনে করতেন। তবে পরবর্তীকালে সঞ্জীবচন্দ্র ঠিক সরাসরি এই ঘটনা প্রসঙ্গে না-হলেও, এমন ঘটনা যে অলৌকিক নয়, তা প্রমাণ করেছিলেন ‘সৎকার’ নামক প্রবন্ধে।
‘সৎকার’ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, অনেক সময় কাউকে মৃত বলে মনে হলেও, তাঁর নাড়ি খুঁজে না-পাওয়া গেলেও, তিনি কিন্তু সত্যি সত্যি মারা যান না। মৃত্যুপ্রতিম অবস্থা হয় মাত্র। তাঁর হৃদস্পন্দন, নাড়ি, শ্বাস প্রভৃতি অনেক সময়ই টের পাওয়া যায় না। অপেক্ষা করলে বা সঠিক শুশ্রূষা করলে সেই ব্যক্তি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। এ-কারণেই কাউকে মৃত মনে হলেই সঙ্গে সঙ্গে দাহ করা উচিত নয়, কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করা উচিত।
সঞ্জীবচন্দ্রের প্রবন্ধকে মাথায় রেখে যাদবচন্দ্রের পুনর্জীবনলাভের বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যেঃ দারুণ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ঐ সন্ন্যাসী তাঁর মৃতপ্রতিম দেহে নিশ্চয়ই প্রাণলক্ষণ দেখেছিলেন। তাই দাহে বাধা দিয়েছিলেন। এবং বাঁচাতে পেরেছিলেন।
পিতার এই অলৌকিক জীবনলাভের কাহিনি বঙ্কিমচন্দ্র কোনদিন অবিশ্বাস করার কথা ভাবেননি। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সাধনায় অলৌকিক বা দৈবসিদ্ধ হওয়া সম্ভব। জগৎসংসারে তেমন সন্ন্যাসী দুর্লভ নয়। তাঁর উপন্যাসামালায় অধিকাংশেই তাই দৈবজ্ঞ চরিত্রের অমন সন্ন্যাসীর উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পড়ে। তাছাড়া ব্যক্তিগত জীবনেও বহুবার বহু সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা জানা যায়। এই সাক্ষাৎমালা তাঁর ব্যক্তিমনকে প্রভাবিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে।
বঙ্কিমের প্রথম স্ত্রীর যখন মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স সবে বাইশ। সাত বছরের খুনসুটি আর ভালোবাসামাখা সেই দাম্পত্যজীবন হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়ায় বঙ্কিমের জীবনে একটা সাময়িক শূন্যতা নেমে আসে। শোনা যায়, এই সময় সংস্কৃতজ্ঞ মাতামহের বেশ কিছু পুরাতন পুঁথি উত্তরাধিকসূত্রে বঙ্কিমের হাতে আসে। তাদের মধ্যে কয়েকটি জ্যোতিষ ও তন্ত্রের পুঁথিও ছিল। পুথিগুলি তাঁকে জ্যোতিষচর্চায় দারুণভাবে উৎসাহিত করেছিল। ফলত, তিনি অচিরেই শুরু করেছিলেন ফলিত জ্যোতিষের চর্চা। এবং নিরন্তর ও মনোযোগী চর্চায় এই বিষয়ে তিনি যথেষ্ট কৃতবিদ্য হয়েছিলেন শোনা যায়।
সব মিলিয়ে বঙ্কিমের সাহিত্যে জ্যোতিষীর ভূমিকা তাই যথেষ্ট পরিমাণেই দেখা যায়। তাঁদের ভবিষ্যৎবাণী অমোঘভাবে কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করে ফলে যেতেও দেখা যায়।
বঙ্কিমের প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে। এতে অভিরাম স্বামী নামক জ্যোতিষ পারদর্শী সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তিনি গণনা করে বলেন যে, ‘মোগল সেনাপতি হইতে তিলোত্তমার মহৎ অমঙ্গল।’ দেখা যায়, তাঁর এই ভবিষ্যৎবাণীটিকেই উপন্যাসের ঘটনাপরম্পরা নিয়ন্ত্রণে আখর হয়ে উঠতে।
‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯ খ্রি.) উপন্যাসে জ্যোতিষী-সন্ন্যাসী বলেছিল যে, মনোরমা বিধবা হয়ে সহমৃতা হবে। ভবিষ্যৎবাণী এখানেও অমোঘ হয়েছে। কাহিনিতে মনোরমার পিতা কেশব মেয়েকে রক্ষা করার অনেক চেষ্টা করেও বিধিলিপি খণ্ডাতে পারেনি। শেষমেশ সহমৃতা হওয়াই হয়ে উঠেছে মনোরমার একমাত্র নিয়তি।
ধারা মেনে ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২ খ্রি.) উপন্যাসেও জ্যোতিষীর গণনা ও পথনির্দেশ ব্যাপকভাবে কাহিনিকে প্রভাবিত করেছে। আবার শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’ (১৮৮৭ খ্রি.)-এ কাহিনিবৃত্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কোষ্ঠী বিচার। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সীতারামের স্ত্রী শ্রী’র কোষ্ঠীতে রয়েছে যে, সে ‘প্রিয় প্রাণহন্তী’ হবে, তাই সীতারাম তাকে ত্যাগ করে।
জ্যোতিষ, নিয়তি, অদৃষ্টবাদ বঙ্কিমের সাহিত্যের চরিত্রমালার মাথার ওপর অবিরত চিলের মতো চক্কর কেটেছে শুরু থেকেই। বঙ্কিমের সাহিত্যে এই অদৃষ্টবাদ গ্রিক ট্রাজেডির সূত্র বেয়ে যেমন এসেছিল, শেক্সপিয়রের অলৌকিক অনুষঙ্গের প্রভাব থেকে যেমন এসেছিল; বলা বাহুল্য, তেমনি এসেছিল ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকেও।
সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকেই শুধুমাত্র সাহিত্যের পাত্রপাত্রী নয়, জ্যোতিষবিচারের মধ্য দিয়ে আপন মেয়ের ভাগ্যও জানতে চেয়েছিলেন বঙ্কিম। তাকে সুরক্ষিতও দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। বরং, শাস্ত্রের ফাঁকিতে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। আর সেই আঘাতেই ভেঙে পড়েছে তাঁর আস্থার ধ্বজা।
আসলে বঙ্কিমের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। ছিলেন, শরৎকুমারী, নীলাব্জকুমারী ও উৎপলকুমারী- এই তিন মেয়ে। উৎপলকুমারী ছোট বলে সকলের বিশেষ ভালোবাসার পাত্রী ছিল। আদর করে তাঁকে সবাই ‘পলা’ বলে ডাকতেন।
বঙ্কিম কলকাতার বাঁশতলার বিখ্যাত মুখার্জী পরিবারে পলার সম্বন্ধ করলেন। ছেলের নাম, যতীন্দ্র মুখোপাধ্যায়। নাটক-থিয়েটারে একটু টান আছে। সে অবিশ্যি সব বাবুদেরই খানিক থাকে। তাছাড়া বিখ্যাত বংশ, সেটা তো দেখতে হবে!
বিয়ের আগে বঙ্কিম শুধু যে বংশ দেখলেন, এমন নয়। পাত্র-পাত্রী উভয়ের কোষ্ঠী মিলিয়েও দেখলেন। আগেই বলেছি যে, বঙ্কিম ভালোরকম জ্যোতিষ গণনা করতে পারতেন, বিলক্ষণ কোষ্ঠী বিচারও করতে পারতেন।
তা তিনি নিজে বিচার করে দেখলেন যে, এ-বিয়ে নিশ্চিন্ত সুখের হবে, মঙ্গলের হবে। পাত্রপাত্রী একেবারে ‘রাজযোটক’। শুধু নিজে বিচার করেই তুষ্ট হলেন না বঙ্কিম, ভাল জ্যোতিষীকে দিয়ে আর-একবার বিচার করালেন। সে বিচারেও একই ফল পাওয়া গেল।
কাজেই বেশ নিশ্চিন্তে ধুমধামে মেয়ের বিয়ে দিলেন বঙ্কিম। তারপর আর নিশ্চিন্ত থাকার অবকাশ রইল না। কেননা, ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করল জামাইয়ের আসল স্বরূপ। দেখা গেল, যতীন লোকটি আসলে একটি বখাটে। ‘মদ তো খায়ই, মেয়েছেলেরও দোষ আছে’। গিরিশ ঘোষের নাটকের দলে তার আস্তানা। নটীদের সঙ্গে ফুর্তিতে সে দু’হাতে পয়সা ওড়ায়। নিজের সম্পত্তি ওড়াতে ওড়াতে একসময় টান পড়ল। তখন তার নজর পড়ল অপুত্রক বঙ্কিমের সম্পত্তির ওপর। পলাকে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আদায়ের জন্য নানাভাবে চাপ দিতে শুরু করল।
ইতোমধ্যে বঙ্কিমের স্ত্রী রাজলক্ষ্মীদেবী পলার কাছে হাজার বারো টাকার গয়না রাখতে দিয়েছিলেন। যতীন সেই খবরটি পেয়ে সেগুলো গিলতে চাইল। পলা কিছুতেই দিল না। অত্যাচার শুরু হল। মুখ বুজে তাও সহ্য করল পলা।
যতীন তখন উচ্ছৃঙ্খলতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। বুঝে গেছে, বেঁচে থাকতে পলা তাকে গয়নাগুলো কিছুতেই দেবে না। তাই তাকে শেষ করে দেওয়ারই পরিকল্পনা ফেঁদে বসল সে। আর তার এই কুপ্রবৃত্তিতে দোসর হল বিনোদ নামে তার এক ডাক্তার বন্ধু। চক্রান্ত সম্পূর্ণ করে দু’জনেই রইল সুযোগের অপেক্ষায়।
সুযোগ মিলতে দেরি হল না। ক’দিনের মধ্যেই পলা সামান্য অসুস্থ হল। অমনি যতীন ওষুধ দেওয়ার ছল করে ডাক্তারের কাছ থেকে বিষ এনে খাইয়ে দিল তাকে। পলা আর যাই হোক, এতটা অবিশ্বাস করতে পারেনি। তাই ওষুধ ভেবে খেয়ে ফেলল মারাত্মক বিষ। সেই বিষের প্রভাবে খানিক পরেই মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করল সে…
যতীনের চক্রান্ত তাতেও পূর্ণ হল না। সে পলার মৃত্যুকে নিশ্চিত করতে ঐ অবস্থায় গলায় কাপড় বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। পলা মারা গেল। যতীন রটাল, সে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পোস্টমরটেম রিপোর্টে বিষ প্রয়োগের ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেল। কেসটা কোর্ট অব্দি গড়াল।
কিন্তু সে তো পরের কথা। পলার এই আকস্মিক ও অপঘাত মৃত্যুসংবাদ বঙ্কিমের পরিবারের সকলকে একেবারে হতচকিত করে তুলেছিল, বিহ্বল করে তুলেছিল। আর বঙ্কিমকে করে তুলেছিল চরম অনুশোচনায় দগ্ধ। মনে হয়েছিল কীসের কোষ্ঠী, কীসের বিচার, কীসের শুভাশুভ, কীসের ভাগ্য! সব মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে! ভাইপো জ্যোতিশচন্দ্রকে একটি চিঠিতে লিখলেনঃ
‘জ্যোতিষ শাস্ত্রের গণনার উপর কিছুমাত্র বিশ্বাস করিবে না। আমি উহার অনেক পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া এক্ষণে উহাতে বিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়াছি।’…