বংশী চন্দ্রগুপ্তঃ বাংলা সিনেমার অন্দরসজ্জায় যুগান্তর এনেছিলেন যে কাশ্মীরি পণ্ডিত

বংশী চন্দ্রগুপ্ত বাংলা জানতেন না, অথচ বাংলা সিনেমার অন্দরসজ্জায় প্রথম বাস্তবধর্মীতার প্রয়োগ ঘটিয়ে যুগান্তর এনেছিলেন তিনিই। জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি, বংশসূত্রে কাশ্মীরী পণ্ডিত। চারের দশকের মাঝামঝি কলকাতায় এসেছিলেন ছবি-আঁকা অর্থাৎ চিত্রবিদ্যা শিখতে। তখন কে জানত, বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমায় যুগান্তর আসবে তাঁরই হাত বেয়ে!

আসলে ছোট থেকেই বংশীর স্বপ্ন ছিল যে, চিত্রকর হবেন। যৌবন অব্দি সেই স্বপ্ন লালন করে  শ্রীনগরে পড়াশুনোর ফাঁকে একদিন ঠাকুরবাড়ির বিদ্রোহী ও বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শুভো ঠাকুরের কাছে নাড়া বাঁধার সুযোগ পেলেন। তাঁরই পরামর্শে একদা এলেন কলকাতায়, যোগ দিলেন শুভো ঠাকুর, নীরদ মজুমদার প্রমুখ প্রথাবিরোধী শিল্পীদের প্রতিষ্ঠিত সংঘ ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’-এ। বিশ্বশিল্প নিয়ে পড়াশুনো করতে যাতায়াত শুরু করলেন আমেরিকান লাইব্রেরিতে। সেখানেই আলাপ হল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। অচিরেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সত্যজিৎ সান্নিধ্যে সিনেমার প্রতি আগ্রহ তৈরি হল। চলতে লাগল একের পর একে বিদেশি ছবি দেখার পালা। পাশাপাশি চলতে লাগল সিনেমা তৈরির পরিকল্পনা। তাঁদের সঙ্গে জুটলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত, সুব্রত মিত্রের মতো সিনেমা-উৎসাহী যুবকেরা। প্রতিষ্ঠিত হল, ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’।

সিনেমার প্রতি বংশীর উৎসাহের কথা জানতে পেরে খুব খুশি হলেন শুভো ঠাকুর। তিনি চিরকালই প্রথার বাইরে যারা ভাবতে পছন্দ করেন, তাঁদের ভালোবাসেন। ফলে, তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তখনকার বিখ্যাত আর্ট ডিরেক্টার বটু সেনের সহকারী হিসেবে বংশীকে সিনেমা-লাইনে ভিড়িয়ে দিলেন।

১৯৪৭ সাল। হেমেন গুপ্তের ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে বটু সেনের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন বংশী। এই সময় হঠাৎ-ই একটা সুযোগ ঘটে গেল বংশীর নিজেকে প্রমাণ করার। ছবির শ্যুটিং যখন মাঝপথে তখন বটু বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কাজেই সহকারী হিসেবে বংশীর ওপর বাকি কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব এসে পড়ল। আর বংশী সেটা এমন সুন্দরভাবে উৎরে দিলেন যে, চলচ্চিত্রের কলাকুশলীমহলে তাঁর বেশ সুনাম হয়ে গেল রাতারাতি। কাজের জন্য ডাকও পেতে লাগলেন খুব।

তিন বছর পর তাঁর জীবনে অনন্য একটি কাজের সুযোগ। যে কাজ তাঁকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করল। আসলে, ১৯৫০ সালে বিখ্যাত ফরাসি চিত্রপরিচালক জ্যঁ রেনোয়া এলেন কলকাতায় ‘দ্য রিভার’ ছবির শ্যুটিং করতে। এই ছবিতে প্রোডাকশন ডিজাইনার ইউজিন লউরির সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলেন বংশী। শ্যুটিং-এর বাজেট নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে খুব সাধারণ জিনিস দিয়ে অসাধারণ কিছু করার শিক্ষা যেমন পেলেন তিনি, তেমনি পেলেন চরিত্রের পোশাক ও গৃহস্থালির আসবাব, আলপনা, বাসনপত্র, দৈনন্দিনের ব্যবহার্য ও অব্যবহার্য সামগ্রী বিশেষ অবস্থানে স্থাপন করে ব্যাপক ব্যঞ্জনা তৈরির শিক্ষা। চিত্র আর চলচ্চিত্রের ভাষায় যাকে বলে, ‘মিজঁ-সিন’ (mise-en-scene)। আর এই অর্জিত শিক্ষার কথা তিনি প্রতিদিনের শ্যুটিং শেষে বন্ধু সত্যজিৎকে এসে শোনাতেন, তাতে অসম্ভব সমৃদ্ধ হতেন সত্যজিৎ।

চলচ্চিত্রের ভাষাকে বুঝে, ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ বুঝে সেট-নির্মাণ ও তাতে বাস্তবধর্মীতা রক্ষার যে শিক্ষা বংশী অর্জন করেছিলেন; তা প্রয়োগ করে আলোড়ন ফেললেন ১৯৫৩ সালে সত্যেন বসুর ‘ভোর হয়ে এলো’ ছবিতে। কিন্তু অর্জিত শিক্ষার চরম প্রয়োগ দেখালেন ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫)-তে।

‘পথের পাঁচালী’ এই যে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার মাইলস্টোন হয়ে উঠল, এর পেছনে পরিচালক-চিত্রনাট্যকার সত্যজিৎ রায়, ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র, সঙ্গীতকার রবিশঙ্কর, সম্পাদক দুলাল দত্ত’র যেমন পৃথক পৃথক অবদান রয়েছে, তেমনি রয়েছে বংশী চন্দ্রগুপ্তেরও অবদান। ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং হয়েছিল বোড়াল গ্রামে, গ্রামের সত্যিকারের বাড়িতে। ছবিতে একটি রাত্রিকালীন ঝড়ের দৃশ্য আছে, যেখানে সর্বজয়ার ঘরের ভেতর সেই ঝড়ের দাপটে লজঝরে দেওয়ালে ভাঙা জানালার পাল্লাটা উদ্দাম আওয়াজ করছে। ঘরের ভেতরের এই পুরো দৃশ্যটি শ্যুট করা হয়েছে স্টুডিওতে সেট বানিয়ে। কিন্তু বংশী সেই আউটডোরের অর্থাৎ গ্রামের সত্যিকারের বাড়ির বাইরের অংশের সঙ্গে মিলিয়ে এত সুন্দর ভেতরের অংশটি স্টুডিওতে নির্মাণ করেছিলেন যে, কিছুতেই বোঝার উপায় নেই যে, ভেতরের দৃশ্যটি অন্য কোথাও চিত্রায়িত হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবারের অবস্থার কথা ও সিনের মুডের কথা মাথায় রেখে অন্দরসজ্জা দৃশ্যটিকে আরও ব্যঞ্জনাময় করেছে। এরকম উদাহরণ ছবির সর্বত্র রয়েছে। আর সেগুলোকে ছবির সম্পদ করে তোলাতেই বংশীর কৃতিত্ব। শুধু ‘পথের পাঁচালী’ নয়, পরবর্তী প্রতিটি ছবিতেই বংশী তাঁর কৃতিত্ব ও নিজস্বতার স্বাক্ষর বজায় রেখেছেন।

তবে ‘পথের পাঁচালী’(১৯৫৫)-তে সত্যজিৎ-এর সঙ্গে তিনি যে শিল্পযাত্রা শুরু করেছিলেন, তা শেষ হয় ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ (১৯৭৭) ছবিতে এসে। সত্যজিতের সঙ্গে শিল্পগত মত-পার্থক্যের কারণেই দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি বম্বে চলে যান। তবে সেখানেও তিনি কুমার সাহনী, বাসু চ্যাটার্জি, শ্যাম বেনেগাল প্রভৃতি বিখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পীদের ছবিতে অসাধারণ কাজ করেছেন। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। মুজাফফর আলির ‘উমরাও জান’(১৯৮১)-এ তাঁর কাজ পেয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা।  

১৯৫৫ থেকে ১৯৭৭—এই দীর্ঘ বাইশ বছরে সত্যজিৎ যতগুলো ছবি করেছেন, তার প্রতিটিতেই শিল্প-নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন বংশী। সত্যজিতের ছবির ফাঁকে ফাঁকে করেছেন অন্যদের জন্যও অসাধারণ সব কাজ। তরুণ মজুমদারের ‘এতটুকু বাসা’ (১৯৬৫), ‘বালিকা বধূ’ (১৯৬৭); মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০), ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫); মার্চেন্ট আইভরির ‘দ্য গুরু’ (১৯৬৯) প্রভৃতিতে তাঁর কাজ আজও চলচ্চিত্রের শিল্প-নির্দেশকদের প্রাণিত করে, শিল্পরসিকদের অন্দরে সঞ্চার করে এক অসাধারণ শৈল্পিক অনুভূতি।

বংশী চন্দ্রগুপ্তই প্রথম শিল্প-নির্দেশক, যিনি সিনেমার সেট ও প্রপস নির্মাণে প্লাস্টার অব প্যারিস-এর প্রচলন ঘটান। প্লাইয়ের ওপর কাগজ ও তুলো সাঁটিয়ে অন্দরের দেওয়াল তৈরিতেও তিনিই প্রথম পথ-প্রদর্শক। দেওয়ালে, কাপড়ে, আসবাবে কীভাবে সময়ের ছাপ তুলে ধরতে হয়; তার বিভিন্ন রকমের পদ্ধতি তিনি উদ্ভাবন করেন। আর তাঁর উদ্ভাবিত ও প্রবর্তিত সেই সব কলাকৌশল এখনও প্রয়োগ হয়ে চলেছে সমগ্র দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের আঁতুড়ঘরগুলিতে। প্রতিভাবান এই শিল্পী ১৯৮১ সালের ২৭ জুন আমাদের ছেড়ে চলে যান মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে…       

              

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...