জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি শহরের ওপর দিয়ে কিছুটা গেলেই নিয়ম ময়নাগুড়ি রেলস্টেশন। ক্রসিং পেরলেই কাঁচা রাস্তা। সবুজ ধানখেত। মানুষকে ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত একটা গ্রাম। গ্রামের নাম ব্যাঙকান্দি। এই গ্রামে রয়েছে মাটির বাড়ি ঘর। লৌকিক দেবতারা এখানে গ্রামের মানুষের কাছে একেবারে আপনজনের মত। তেমনি দুই দেবী ব্যাঙকান্দি ও ঢ্যাকাছাড়ি। ময়নাগুড়িতে রয়েছে অনেকগুলো লোকিক দেব-দেবী থান। একটি বিশেষ থান রয়েছে রাস্তার ধারে। এখানে পূজিত হন শিব ঠাকুর। সেখান থেকে বাঁদিকে বাঁক নিতেই রাস্তা আরও চেপে গেছে। কিছুটা দূরেই রয়েছে নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশন। স্টেশনের পাশ দিয়ে স্রোতের মতো বয়ে চলেছে ধানক্ষেত। মাঠ ভর্তি পাকা ফসল। এই রাস্তায় পড়ে সোদর খৈ নামের লৌকিক দেবতার মন্দির। মন্দির, ধানক্ষেত পেরোলেই একটা টিনের চালা দেওয়া ছোট্ট ঘর। সঙ্গে নিকোন উঠোন। একেবারে গ্রামের বাড়ির মত। এটা আসলে লৌকিক দুই দেবীর থান। তাদের নাম ব্যাঙকান্দি ও ঢ্যাকাছাড়ি। ব্যাঙকান্দি গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবেই এখানে পূজিত হন এই দুই লৌকিক দেবী। ময়নাগুড়ি থেকে খানিকটা দূরে স্রোতের মতো গ্রামটার নাম ব্যাঙকান্দি।
জনশ্রুতি এই যে ব্যাঙকান্দি ঠাকুরের নাম অনুসারে এই গ্রামের নাম হয়েছে। তাঁর বোন ঢ্যাকাছাড়ি। দুই বোন এক সঙ্গে এই গ্রামে পুজিত হন। এই দুই দেবীকে নিয়ে লোকশ্রুতি রয়েছে এখানে। শোনা যায় বহু বছর আগে একবার ব্যাঙকান্দি ও ঢ্যাকাছাড়ি দিঘীর পাড়ে খেলা করছিল। খেলতে খেলতে ওদের দুজনের মধ্যে ব্যাঙকান্দির পায়ের তলায় নাকি একটা ব্যাঙ ঢুকে পড়ে। ব্যাঙের পিঠে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ছোট্ট ব্যাঙকান্দি।এই ভঙ্গিমায় তৈরি করা হয়েছে দেবীর মূর্তি। এই দেবীর পরনে রয়েছে লাল শাড়ি, মাথায় মুকুট। আর ব্যাঙকান্দির বোন ঢ্যাকাছাড়ির শাড়ির রং সবুজ। এঁরা দুজনেই আশীর্বাদসূচক মুদ্রায় দাঁড়িয়ে থাকেন। সাধ্যমত অলংকার দিয়ে সাজিয়ে দেন ওই অঞ্চলের মানুষ।
এই দুই দেবীকে নিয়ে শোনা যায় আরেকটি জনশ্রুতি। এখানে আগে ১৮ টা দিঘী ছিল। দিঘির পাড়ে বসবাস করত অজস্র ব্যাঙ। এই ব্যাঙের কান্না থেকেই এখানকার নাম হয়েছে ব্যাঙকান্দি।
এই দুই দেবীর পুজো হয় ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায়। উপকরণ সামান্য। ফলমূল, মিষ্টি দই, চিঁড়ে, আতপ চাল আর ডাব। অনেকেই দেবীর উদ্দেশে কোন পশুকে খাইয়ে তা উৎসর্গ করেন। দুই দেবীর জন্য দুটো ঘট বসানো হয়। এখানে আগেই পূজোয় বলি হত। তবে বর্তমানে বলির প্রথা উঠে গেছে। এখনো কেউ দেবীর উদ্দেশে মানত করলে পুজোর সময় কোন প্রাণী উৎসর্গ করে তাকে ছেড়ে দেন। এখানে পূজা করেন মূলত রাজবংশী রা। পুজোয় কোন শাস্ত্রীয় মন্ত্র পাঠ করা হয় না। আদ্যন্ত স্থানীয় ভাষায় লেখা মন্ত্র পাঠ করা হয়।
এটাও শোনা যায় যে,ব্যাঙকান্দি ও ঢ্যাকাছাড়ি নামে দুটো জনপদ ছিল। জনপদের মানুষরা আত্মীয়ের মতোই আপন করে নিয়েছিলেন একে অপরকে। এই দুই জনপদের আত্মীয়তা বোঝাতেই নাকি এই দুই দেবতার পূজা করা হয়। তবে জনশ্রুতি যাই থাকুক এই দুই দেবতা ওই গ্রামের মানুষের আত্মীয়।