বাঙালির আবেগ সাহিত্য পরিষদ

 উনিশ শতকের শেষ দিক। বাংলায় জন্ম নিচ্ছে বাঙালি জাতিয়তাবাদ। একদিকে সংস্কৃত অন্য দিকে ইংরেজির দাপট। দুইয়ের চাপে দমবন্ধ অবস্থা বাংলা ভাষার। বাংলা সংস্কৃতির অবস্থাটাও ছিল অনেকটা একই রকম। অবস্থাটা পাল্টাতে শুরু হল অন্য রকম ভাবনার মাধ্যমে। বাঙ্গালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার পড়ল একটা মঞ্চের। একটা প্রতিষ্ঠানের।

শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠল ‘বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অফ লিটারেচার’। সভাপতির পদে বিনয়কৃষ্ণ। সভার উদ্যেশ্য বাংলা ভাষার উন্নতি সাধন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তৈরি হল সমস্যা। যে প্রতিষ্ঠানের জন্মই বাংলা ভাষার চর্চার জন্য সেই প্রতিষ্ঠানেই কার্যবিবরণী থেকে শুরু করে মুখপত্র সবেতেই দেখা যেত ইংরেজির ভুল ব্যবহার। এমনকী দেশিয় ভাষাকে বাঁচানোর জন্য যে প্রতিষ্ঠান তার ‘নাম’ পর্যন্ত ভিনদেশি! সদস্যরা অনেকেই আপত্তি তুললেন। এলো নাম বদলের কথাও।

১৩০১ বঙ্গাব্দের ১৩ বৈশাখ সভার নামবদল হল। নতুন নাম বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ প্রস্তাবক উমেশচন্দ্র বটব্যাল। সভার সভাপতি পদে রমেশচন্দ্র দত্ত। সহ-সভাপতি নবীনচন্দ্র সেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পাদক এল লিওটার্ড।

সভার সদস্য সংখ্যা বাড়তে লাগল ধীরে ধীরে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বহু সদস্য সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলেন সভার কাজের সঙ্গে। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে সভার সদস্য ৩৫০। সভাপতির পদে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

গগনেন্দ্র ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও অনেকে প্রস্তাব তুললেন পরিষদের কার্যালয় শোভাবাজার রাজবাড়ি তথা বিনয়কৃষ্ণ দেবের বাড়ি থেকে সরিয়ে, ‘সাধারণ প্রকাশ্য স্থানে’ করা হোক।  

অনেকেই এই প্রস্তাবের বিপক্ষে মত দিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হল কার্যালয় স্থানান্তরের প্রস্তাব।

‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’  উঠে এল আজকের টাউন স্কুলের উত্তরে ভাড়াবাড়িতে। কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর আনুকূল্যে পরিষদের নিজস্ব বাড়ি তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয় ১৯০১-এ।

 ২৪৩/১ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড,  তখন আপার সার্কুলার রোড। সেখানেই হালসিবাগানে সাত কাঠা জমি পরিষদকে দান করেন মনীন্দ্রচন্দ্র। চাঁদা তোলা হয় বাড়ি তৈরির জন্য। মোট খরচ হয় ২৭ হাজার টাকা। ভবনের দোতলা তৈরির পুরো দশ হাজার টাকাই দেন লালগোলার মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়। মুর্শিদাবাদের শ্রীনাথ পাল দেন আড়াই হাজার বর্গফুট মার্বেল। 

১৯০৮-এর ডিসেম্বরে পরিষদ নিজস্ব ভবনে উঠে আসে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ - এর গৃহপ্রবেশের দিন ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে অদ্ভুত উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল। বাংলা ও বাঙালির জাতিয়তাবোধের বিস্ফোরণ যেন! জনজোয়ার সামলাতে ভবনের একতলা আর দোতলায় আলাদা আলাদা সভা করতে হয়েছিল পরিষদের  সদস্যদের।

পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র 'প্রকাশনা'। ১২০ বছর ধরে সাহিত্য-পরিষদ-পত্রিকা-র প্রকাশ অব্যাহত, তেমনই বহু মূল্যবান বই, গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যা আসলে শুধু বই নয়, একটা জাতির সত্ত্বা ও সময়ের দলিল।    

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...