বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। মাতৃ আরাধনায় নিয়মকানুনের শেষ নেই। বনেদি পরিবারগুলোতে আজও সব রীতি, রেওয়াজ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়। কিছু কিছু পরিবারের আবার বিশেষ কিছু কিছু নিয়মও থাকে। তেমনই একটি নিয়ম হল ধুনো পোড়ানো এবং বেড়া অঞ্জলি।
বিডন স্ট্রিটের ভোলানাথ ধামে এই রীতি দেখা যায়। ভোলানাথ দত্ত ছিলেন গন্ধ দ্রব্যের ব্যবসায়ী। দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল ১৯০৫ সালে। ১৯২৫ সাল থেকে কলকাতার গোলক দত্ত লেনে মায়ের পুজো শুরু হয়। এই বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা অসুরদলনী নন, বরাভয়দায়িনী, বৃষারূঢ় ভোলানাথের কোলে অধিষ্ঠান করেন। শিবকে এখানে বাড়ির জামাই হিসেবে পুজো করা হয়। আর দুর্গা হলেন বাড়ির মেয়ে। অষ্টমী এবং নবমীর দিন আয়োজন হয় ধুনো পোড়ানোর। বাড়ির মহিলারা দেবী প্রতিমার সামনে দুই হাতে এবং মাথায় নতুন গামছা নিয়ে তার উপর নতুন মালসা বসান। সেই মালসাতেই পোড়ানো হয় ধুনো। পাশাপাশি বেড়া অঞ্জলি দেওয়া হয়। দশমীর দিন বরণ সেরে সূর্যাস্তের পর ঠাকুরদালান থেকে প্রতিমাকে বের করে আনা হয়, তারপর বাড়ির মহিলারা দেবীকে প্রদক্ষিণ করে অঞ্জলি দেন। এই প্রথাকে বলা হয় বেড়া অঞ্জলি।
উত্তর কলকাতার কলুটোলার বদনচাঁদ রায়ের বাড়ির পুজোতেও ধুনো পোড়ানো হয়। নিজের বাড়িতে ১৮৫৭ সালে দুর্গাপুজো শুরু করেন বদনচন্দ্র রায়। মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ শুক্ল প্রতিপদাদিকল্পে হয় বোধন। অষ্টমী ও সন্ধিপুজোয় বাড়ির মহিলারা ধুনো পোড়ান।
উত্তর কলকাতার চোরবাগানের শীলবাড়িতে অষ্টমীতে ধুনো পোড়ানোর রীতি রয়েছে, বাড়ির একমাত্র দীক্ষিত মহিলারাই ধুনো পোড়ানোতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বাড়ির সকল বিবাহিত দীক্ষিত মহিলারা সন্তানের মঙ্গল কামনার্থে ধুনো পোড়ানোয় অংশ নেন। ধুনো পোড়ানোর সময় বাড়ির সকল বিবাহিতারা তাঁদের সন্তানদের কোলে বসিয়ে রাখেন। রানাঘাটের পালবাড়ির পুজোয় অষ্টমীতে ধুনো পোড়ানো হয়।
মূলত গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের দুর্গাপুজোয় এই ধুনো পোড়ানো, বেড়া অঞ্জলির রীতি পরিলক্ষিত হয়। পরিবার ভেদে দিনের পার্থক্য হয়। কেউ কেউ অষ্টমীর দিন ধুনো পোড়ান, আবার কোনও কোনও বাড়িতে নবমীর দিন ধুনো পোড়ানো হয়। মহিলারা এক সঙ্গে বা এক-এক করে ঠাকুরের সামনে বসেন। তাঁদের দুই হাতে এবং মাথায় নতুন গামছা দিয়ে বিড়ে বানিয়ে তার উপর নতুন মালসা বসানো হয়। তারপর সেই মালসার মধ্যে ধুনো পোড়ানো হয়। এক এক জন তিনটি করে নতুন মালসায় ধুনো পোড়ান। সন্তান ও পরিবারের মঙ্গলকামনায় এই অনুষ্ঠান পালন করেন বাড়ির মহিলারা। আবার বিসর্জনের দিন ঠাকুর বরণ হয়ে যাওয়ার পর উঠোনে প্রতিমা নামিয়ে তার চারদিকে মহিলারা ঘুরে ঘুরে অঞ্জলি দেন। এই প্রথাকেই বলা হয় বেড়া অঞ্জলি।