নয় দেবীর সমাহারে নবপত্রিকা

দুর্গা পুজোর মণ্ডপে গেলে প্রতিমার পাশে শাড়ি পরা একটি বউ দেখা যায়। আমরা সাধারণত তাকে কলাবউ নামেই চিনে থাকি। তবে তার পোশাকি নাম " নবপত্রিকা"।

নবপত্রিকা আসলে ৯টি উদ্ভিদের সমাহার। এই ৯টি উদ্ভিদকে দেবী দুর্গার ৯টি বিশেষ রূপের প্রতীক রূপে কল্পনা করা হয়। নবপত্রিকা বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। নবপত্রিকার আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। বাস্তবে অবশ্য নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ।

কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান ও ধ্বনি। এই হল নয়টি উদ্ভিদ। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ, একজোড়া বেল ও শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। স্ত্রীরূপের জন্য দুটি বেল দিয়ে স্তনযুগল তৈরি করা হয়। সিঁদুর দিয়ে সপরিবারে প্রতিমার ডানদিকে দাঁড় করিয়ে নবপত্রিকার পুজো করা হয়।

নয়টি উদ্ভিদে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ আছে বলে কল্পনা করা হয়।

১) কদলী( কলা): এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রক্ষ্মানী।

২) কচু: এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা।

৩) হরিদ্রা( হলুদ): এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা।

৪) জয়ন্তী: এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী।

৫) বিল্ব (বেল): এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা।

৬) দাড়িম্ব (দাড়িম): এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা।

৭) অশোক: এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা।

৮) মান: এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা।

৯) ধনি: এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী।

এই নয় দেবী "নবপত্রিকা বাসিনী নবদুর্গা" নামে নবপত্রিকা বাসিন্যৈ নবদুর্গায় নমঃ মন্ত্রে পূজিতা হন।

আগে মহাসপ্তমীর দিন কাছাকাছি নদী বা জলাশয়ে নবপত্রিকা নিয়ে যাওয়া হত। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নিয়ে যেতেন। তাঁর পিছনে বাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যেতেন। এখন অবশ্য সব জায়গায় তা করা সম্ভব হয় না।

শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান হয়ে গেলে নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর দেবীর ডানদিকে একটি কাঠের সিংহাসনে বসানো হয়। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকার প্রবেশের অর্থ দুর্গাপুজোর মূল অনুষ্ঠানের সূচনা।

নবপত্রিকা আসার পর দেবীকে দর্পনে মহাস্নান করানো হয়। বাকি দিনগুলোতে নবপত্রিকা দেব-দেবীদের সঙ্গেই পূজিত হয়। পুজো মণ্ডপে নবপত্রিকা আসার আগে পত্রিকার সামনে দেবী চামুণ্ডার পূজা হয়। পত্রিকার কোন দেবীকে পৃথকভাবে পুজো করা হয় না।

বিভিন্ন গবেষকদের মধ্যে নবপত্রিকা নিয়ে নানান মত রয়েছে। মনে করা দেবী দুর্গা শষ্যের প্রতীক। এই নবপত্রিকা সেই প্রতীক বহন করে চলেছে। আবার কেউ মনে করেন নবপত্রিকা পরবর্তীকালে সংযোজন হয়েছে। শবরাদি জাতির মধ্যে নয়টি গাছের পাতা সামনে রেখে নবরাত্রি উৎসবের প্রচলন ছিল। পরবর্তীকালে তার দুর্গা প্রতিমার পাশে স্হাপিত হয়।

মার্কেণ্ডেয় পুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ নেই। পুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ না থাকলেও সপ্তমীতে পত্রিকা পূজার উল্লেখ রয়েছে। কৃত্তিবাসী রামায়নে রামচন্দ্র কর্তৃক নবপত্রিকা পুজোর উল্লেখ আছে- " বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস"।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...