রবীন্দ্রনাথ তাঁকে 'চিত্ররূপময় কবি'র মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতায় আমরা খুব পরিচিত চিত্র দেখতে পাই- যেমন তাঁর 'বনলতা সেন'।
“আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন/.....
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা”-
কে এই বনলতা সেন? তিনি যে কোনো সাধারণ নারী নন তা কবির কথাতেই স্পষ্ট। ৫৫ বছরের স্বল্প জীবনে হাজার বছর ধরে হাঁটার ক্লান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই ক্লান্তি কেবল কবির একার নয় লক্ষ লক্ষ পুরুষের, যারা বনলতা সেন রূপী নারীদের কাছ থেকে শান্তি আর আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর কথাতেই বলি, তিনি এখানে যেমন বিম্বিসার অশোকের কথা বলেছেন তেমনি বাংলা দেশের আধুনিক শহর নাটোরের কথাও উল্লেখ করেছেন -সেই যুগ থেকেই নারীর অস্তিত্ব বা নারীর আশ্রয় ক্লান্ত পুরুষদের কাছে স্বর্গ লাভের মতন শান্তি প্রদান করে ।
বিখ্যাত কবিতার নারী বনলতা সেন কে? তার জীবনের বনলতা সেন এর বাস্তবতাই বা কতটা? যিনি দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো? যে মানুষকে প্রতি দিন প্রতি নিয়ত ভাবিয়ে তুলছে? কবির সঙ্গে যেন সকল পাঠকগণ একবার বনলতার সেন এর মুখোমুখি বসার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।
জীবনানন্দের গুণগ্রাহী ও জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় তাঁর ‘জীবনানন্দ’ বইয়ে লিখছেন: ‘‘এক দিন সকালে গেছি। গেলে ঘরে বসিয়ে বললেন— আমার ‘বনলতা সেন’ কবিতার বইটা সিগনেট প্রেস বার করেছে।— এই বলে তিনি আমার হাতে একখানা ‘বনলতা সেন’ দিয়ে বললেন— কাগজ, ছাপা, বাঁধাই সবই ভাল, কিন্তু কভারের ছবিটা আমার আদৌ পছন্দ হয়নি"
গোপাল চন্দ্র বাবু কবিকে জিজ্ঞেস করেন -"আপনি তো লিখেছেন— ‘নাটোরের বনলতা সেন’।-এই নামে সত্যিই আপনার পরিচিতা কেউ ছিল নাকি?" কবি তার কথার উত্তর না দিয়ে কেবল মুচকি হাসি হাসলেন। অর্থাৎ তার অস্তিত্ব অস্বীকার বা স্বীকার কোনোটাই করলেননা।
তবে এমন কথা লোকমুখে প্রচারিত হয়ে আসছে, বনলতা সেন আর কেউ নন তিনি সুচিত্রা সেন। কারণ তার চোখ তুলে তাকানোর ভঙ্গিমা আর বনলতা সেন এর ব্যাখ্যা হুবহু মিলে যায়। সুচিত্রা সেন-এর আদি বাড়িও বাংলাদেশের নাটোরে। তাই নাটোরের বিখ্যাত রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয়।
আবার কবির পাণ্ডুলিপি উদ্ধারকারক ব্যক্তি তাঁর দিনলিপিতে পরে জানিয়েছেন -স্ত্রী লাবন্যকে বিয়ে করার আগে কবির কাকা অতুলান্ত দাশের মেয়ে শেফালী দাশকে কবি পছন্দ করতেন। সেই নারীর জন্য স্ত্রী র সঙ্গেও অনেকদিন মনোমালিন্য হয়েছে। তাই হয়তো শেফালী ই কবির বনলতা সেন।
অন্য দিকে বনলতা সেন এর চুল, মুখ শরীরের বর্ণনা দিয়ে রোমান্টিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু সমস্ত বর্ণনাটাই স্বপ্নাচ্ছন্ন।
“তবু তোমাকে ভালোবেসেমুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে বুঝেছি অকূলে জেগে রয়ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয় ।”
কবি জীবনানন্দ নিজে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তাই কবিতার ভাষায় ব্যক্ত করে বলেছেন এই কথাগুলি। জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩)হয়। এছাড়া জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটিও ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৪) লাভ করে।