মৌলিক্ষা মন্দির, তন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্রের মিলনক্ষেত্র

আজ মন্দিরের কথায় আমরা মলুটির কথা জানবো। মহুল গাছের জঙ্গলে ঘেরা এক গ্রাম, নাম মহুলটি। সেটাই মানুষের উচ্চারণে হয়ে গিয়েছে মলুটি, ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলায় শিকারিপাড়া থানা এলাকায় পড়ে গ্রামটি। অবিভক্তি বিহারের সাঁওতাল পরগনা নামে খ্যাত এলাকার এক জনপদ হল মলুটি। এখনও পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে নানকার মলুটি নামের হদিশ মিলবে। একে আরোগ্য নিকেতন বললেও অত্যক্তি হয় না। এক সময় মানুষজন এখানে হাওয়া বদল করতে যেতেন। রোগ সারানোর আদৰ্শ জায়গা বলে পরিচিত মলুটিতে রয়েছে প্রাচীন মৌলীক্ষা মন্দির। রয়েছে মন্দিরের ধর্মশালা। হাল আমলে মন্দিরের একটা গেস্ট হাউসও তৈরি হয়েছে এখানে।

ভিন রাজ্য হলেও মলুটি যেন আস্ত এক টুকরো বাংলা। পাহাড়ি টিলা, চন্দননালা ও চুমড়ে নদী ঘেরা মলুটি যেন মন্দির গ্রাম। কেন এমন নাম? এ গ্রামে রয়েছে অজস্র মন্দির। ছোট্ট একটা গ্রাম হলে কী হবে, এখানে এখনও ৭২টি মন্দির রয়েছে। সব মন্দিরের অবস্থানই খুব কাছাকাছি। জনশ্রুতি রয়েছে, এক সময় নাকি এই গ্রামে ১০৮টি মন্দির ছিল। সাধারণত দেব-দেবীর মূর্তি পশ্চিমমুখী, খুব একটা দেখা যায় না। দুমকা জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম মলুটিতে এখানেই ব্যতিক্রম। এই নানকার রাজবাড়ির কালিপুজো খুবই বিখ্যাত। চারিদিকে শাল মহুলের জঙ্গলের মধ্যে মা তারার দিদি হিসেবে পূজিত হন মা মৌলিক্ষা। মৌলি অর্থাত্‍ যার শিরোভাগের দর্শন পাওয়া যায়, তাই মায়ে নাম মৌলিক্ষা। মাতৃ মূর্তি অষ্টম শতাব্দীর, বৌদ্ধ তান্ত্রিক শৈলীর স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। শীতে মৌলীক্ষা দেবীর বাৎসরিক পুজোর সময়ে এবং কালীপুজোয় মন্দিরে পা রাখার জায়গা থাকে না। 

শোনা যায়, সপ্তদশ শতকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর প্রিয় বাজপাখি খুঁজে এনে দিয়ে বসন্ত রায় রাজত্ব লাভ করেন। এই নানকর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বাজবসন্ত রায়। বাজপাখির বদলে পুরস্কার স্বরূপ রাজ্য পেয়েছিলেন। তাই নামেও জুড়ে গিয়েছিল বাজ। বাজবসন্ত রায়ের কোনও পুত্র ছিল না, তিনি ব্রাহ্মন সন্তান হওয়া সত্বেও এতটাই গরীব ছিলেন যে একজন সামান্য রাখাল বালকের কাজ করতেন।বাল্যকালেই বাবা প্রয়ত হন। তখন গৌড়ের অধিপতি ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। বাদশাহী সড়ক ধরে তিনি উড়িষ্যা থেকে বীরভূমের মধ্য দিয়ে ফিরছিলেন। দীর্ঘ সফরের পর বিশ্রামের জন্য ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে এই মলুটির কাছাকাছি কোথাও তিনি তাঁবু ফেলেছিলেন। সেইসময় তাঁর প্রিয় বেগমের অতিপ্রিয় একটি বাজপাখি সোনার শিকল কেটে পালায়। বেগমের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে। বেগমের প্রিয় বাজপাখি খুঁজে দিতে পারলে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেদিলেন গৌড়াধিপতি। বসন্ত রায় কোনওভাবে ধরতে পেরেছিলেন পাখিটিকে। তিনি বাদশার কাছে নিয়ে গেলে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ খুশি হয়ে আদেশ দিলেন, পরদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বালক বসন্ত রায় ঘোড়ায় চেপে যতটা এলাকা ঘুরে আসতে পারবে, সেই এলাকা তিনি বসন্ত রায়কে নিস্কর দান করবেন। বাদশা তাঁর কথা রেখেছিলেন, প্রায় ১৬ কিলোমিটার ব্যাসের এক বিস্তীর্নভূমি বালক বসন্ত রায়কে তিনি নিস্কর দান করেছিলেন। রাজা উপাধিও দিয়েছিলেন। এই ছেলেই হয়ে ওঠেন রাজা বাজবসন্ত রায়। তখন থেকে সেই যুবক বসন্ত 'বাজ বসন্ত' নামে পরিচিত হন। আর নিষ্কর জমি বলে, রাজ্যের নাম হয় নানকর।

মলুটির ইতিহাস সুদীর্ঘ। একদা মলুটি ছিল সুবে বাংলার অংশ। বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের শাসিত ছিল এই অঞ্চল। কেউ কেউ বলেন, তার থেকেই মলুটি নামের জন্ম। সম্রাট শাহজাহানের আমলে মলুটিতে রাজত্ব করতেন নানকরের তিন রাজ বংশধর- রাজ চন্দ্র, রাম চন্দ্র ও মহাদেব চন্দ্র রায়। মল্লারপুরের শাসক কামাল খাঁর অতর্কিত আক্রমণে রাজ চন্দ্র নিহত হওয়ার পর তাঁর বড় ছেলে রাখড় চন্দ্র রায়, রাজপরিবারের পুরোহিত দণ্ডিস্বামীর সঙ্গে মলুটির জঙ্গলে প্রবেশ করেন। সেখানেই তিনি ভগ্নপ্রায় এক প্রাচীন মন্দিরে পাথরের এক মূর্তি আবিষ্কার করেন। তারপর সেখানেই নগর পত্তন করেন। সেই রাজ বাড়ির বংশ ধরেরা আজও সেখানে পুজো চালিয়ে আসছে।

মলুটি গ্রামে প্রায় এক মাইল এলাকা জুড়ে অজস্ৰ মন্দির রয়েছে। মন্দিরগুলির গায়ে টেরাকোটার কাজ রয়েছে। সেখানে রামায়ণের কাহিনী, মহিষাসুরমর্দিনী ও ছিন্নমস্তার মূর্তির চিত্র খোদাই করা রয়েছে। বাজবসন্ত রায়ের পরিবার, অর্থাৎ রাজপরিবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাঙতে আরম্ভ করে, পরিবারের প্রত্যেক শরিক একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একের পর এক মন্দির তৈরি করতে থাকেন। এখন অবশিষ্ট ৭২টি মন্ডিরের মধ্যে সিংহভাগ মন্দির বাংলার চারচালা ঘরানার স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। বাকিগুলি রেখ দেউল, রাসমঞ্চ, সমতল ছাদ বা একবাংলা শৈলীতে তৈরি। মলুটি প্রকৃত অর্থেই মন্দিরের দেশ। অতীতে শুঙ্গ বংশের আমলে মলুটি গুপ্ত কাশী নামে পরিচিত ছিল। 

বৌদ্ধ, তান্ত্রিক সাধকরা এখানে আসতেন। কথিত আছে, পাটলিপুত্রের রাজা মলুটিতে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। আদি শঙ্করাচার্য কাশী বা বারাণসী যাওয়ার পথে এখানে থেমেছিলেন।।১৮৫৭ সালে তান্ত্রিক সাধক বামদেব তারাপীঠে যাওয়ার আগে মলুটিতে আসেন। তিনি প্রায় আঠেরো মাস এই গ্রামের মৌলিক্ষ্যা মন্দিরে ছিলেন। মৌলিক্ষা মায়ের কাছেই বাবা বামাখ্যাপা প্রথম সিদ্ধ লাভ করেন, মন্দিরের প্রথম পুরোহিত তিনিই, সেই কারণেই মলুটির মৌলিক্ষা মায়ের মন্দির হল সিদ্ধপীঠ। বাবা বামাখ্যাপা এরপর তারাপীঠ চলে যান। মৌলীক্ষা মন্দিরে বামদেবের সাধনা কক্ষে আজও বামদেবের ত্রিশূল ও বামদেব ব্যবহৃত বৃহৎ শঙ্খটি রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, মলুটির সাধনা শেষ করে তারাপীঠ যাওয়ার আগে তাঁর ত্রিশূল এবং শঙ্খ এখানেই রেখে যান বামদেব। স্থানীয় মানুষজন মৌলিক্ষা মাকে ছোটবোন এবং তারা মাকে বড়বোন বলে ডাকেন। কৌশিকী অমাবস্যা ও দীপাবলীতে মলুটি বনাম তারাপীঠ লড়াই চলে।

প্রতি কালী পুজোয় এখানে সারারাত ধরে পুজো চলে। মলুটি দেবী মৌলিক্ষার জন্যেই বিখ্যাত। মৌ অর্থাৎ মাথা, ইক্ষা অর্থাৎ দেখা। বৌদ্ধ তান্ত্রিক সম্প্রদায় বজ্রযানীদের আরাধ্যা সিংহবাহিনী দেবী মৌলিক্ষা হিসেবে নামাঙ্কিত। অবয়ববিহীন শুধুমাত্র দেবীমস্তক হল দেবী মূর্তি।  তারাপীঠের তারা মা পশ্চিম অভিমুখে পূজিতা হন, কারণ পশ্চিম দিকে মায়ের ছোট বোন অর্থাৎ মলুটির মা মৌলিক্ষার মন্দির। কালী পুজোর দিন মাকে পশ্চিমমুখী রাখা হয়। শোনা যায়, বাংলার ১১০৮ সনে অর্থাৎ ইংরেজি ১৭০১ সালে, আবির্ভাব তিথিতে বিশ্রাম মন্দিরে তারামাকে পূর্বদিকে বসিয়ে পুজো শুরু করার তোড়জোড় করছিলেন মন্দিরের তদানীন্তন তান্ত্রিক, পুরোহিতরা। এমন সময় মলুটির নানকার রাজা রাখরচন্দ্র মায়ের সামনে আরাধনায় বসেন। যা দেখে তান্ত্রিক, পুরোহিতরা হৈ হৈ করে ওঠেন এবং রাজাকে আসন থেকে তুলে পুজোপাঠ বন্ধ করে দেন। রাজা মায়ের প্রতি অভিমান করে চলে এসে দ্বারকা নদের পশ্চিম পাড়ে ঘট প্রতিষ্ঠা করে মায়ের পুজো করে মলুটি গ্রামে ফিরে যান। ওই রাতেই প্রধান তান্ত্রিক প্রথম আনন্দনাথকে তারা মা স্বপ্নাদেশে বলেন, রাখরচন্দ্র আমার ভক্ত, সে অভিমান করে চলে গিয়েছে। এবার থেকে পুজোর সময় আমার মুখ যেন পশ্চিমমুখে মলুটির কালীবাড়ির দিকে হয়। সেই থেকে কালীপুজোর বিশেষ তিথিতে মাকে পশ্চিমমুখী বসিয়ে পুজো করা হয়। আজও মৌলিক্ষা মায়ের পুজো দিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় জমান পড়শী রাজ্যে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...