ব্যালকনি বা ছাদবাগানে সহজে ফলান টমেটো

খুব বেশি না, কেজি পাঁচেক মাটি ধরে এমন চারটে পলিব্যাগে চারটে টমেটো চারা বসান এ-বছর। আমি প্রতিবার পলিব্যাগে টমেটো চাষ করি আমার ছাদবাগানে, এবারেও করেছি। কিন্তু আপনি চাইলে টবেও চারা বসাতে পারেন, দশ-বারো ইঞ্চি টবে। ফি-বছরই তো শীতকালীন ফুলের চাষ করেন, এ-বছর না-হয় তাদের সঙ্গে চারটে টমেটোকেও একটু জায়গা দিলেন; দেখবেন, তারা কিন্তু আপনাকে নিরাশ করবে না। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আপনি যত সামান্য যত্নই করুন না কেন, সে আপনাকে ফল দেওয়াতে কার্পণ্য করবে না। আপনার ছাদ বা ব্যালকনিবাগানে যদি চার থেকে পাঁচ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় ধরে রোদ আসে, তাহলে টমেটো গাছ খুব হৃষ্টপুষ্ট হবে, ঝাড় ভালো হবে, গাছ স্বাস্থ্যবান হবে। আর যদি মাত্র ঘন্টাখানেক রোদ আসে তাহলে গাছ খুব দ্রুত বাড়বে, চেহারা একটু রোগামতো হবে, একটু লতানেপানা ঢঙ হবে, রোদের খোঁজে এদিক-ওদিক ডাল ছড়াবে। সময়ে ফুল হবে এবং ফলও পাবেন। কিন্তু কম রোদে ফলের আকার তেমন বড় হবে না। প্রয়োজনীয় রোদ পেলে সাধারণ যত্নে এক-একটি গাছ থেকে পুরো শীতে আপনি গড়ে তিন-চার কেজি করে টমেটো পাবেন। অন্তত আমি পেয়ে চলেছি ক’বছর ধরে।

FotoJet - 2022-10-29T131136.927

অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝমাঝি পর্যন্ত টমেটোর চারা বসানোর আদর্শ সময়। তবে একটু দেরি হলেও ক্ষতি নেই। নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত বসানোই যায়। চারা বসাতে দেরি হলে ফল পেতে দেরি হবে। শীত চলে গেলে তো আর ফল পাওয়া যাবে না। তাই একটু তাড়াতাড়ি চারা বসানোই ভালো।

নিজের হাতে চারা তৈরি করে নেওয়ার তো আর সময় নেই, তাই ওসব ঝক্কির কথা ভাবার দরকার নেই। কাছাকাছির গাছবিক্রেতার কাছে গেলেই রেডি চারা পাওয়া যাবে। এগুলো সবই উপড়ে আনা চারা। তাতে কোন চিন্তা নেই। টমেটো চারা দেখতে নরম, কিন্তু উপড়ে আনলেই মরে যায় না। এগুলো ঠিকভাবে বাড়িতে এনে মাটিতে লাগালে, দশটার মধ্যে দশটাই বেঁচে যায়। শুধু হৃষ্টপুষ্ট নধর-সধর সতেজ-সজীব দেখে চারা নেবেন; কোনভাবেই দুর্বল বা ফ্যাকাসে দেখতে চারা এক্কেবারে নেবেন না, তাহলেই হল।

চারা বাড়িতে এনে ছোট কাপজাতীয় পাত্রে পরিষ্কার জল নিয়ে তাদের শেকড় ও কাণ্ড ডুবিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে, যতক্ষণ না-লাগানোর ব্যবস্থা হয়। গাছবিক্রেতা হরবখত জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে এদের সতেজ রাখে। বাড়িতে এনে এমনি এমনি ফেলে রাখলে এরা ঢলে পড়তে পারে। তাই এই সতর্কতা। বাড়িতে যদি এপসম সল্ট ও রুট হরমোন থাকে; তাহলে এক চিমটে করে জলের সঙ্গে গুলে তাতে চারার শেকড় ও কাণ্ড ডুবিয়ে রাখলে আরও ভালো হয়। না-থাকলেও হাপিত্যেশের কিছু নেই। শুধু জল পেলেও এই চারারা বর্তে যায়।

টমেটো বেশ নরম ও মোলায়েম মাটি পছন্দ করে। দোআঁশ মাটির সেই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এঁটেল মাটি দেড় ভাগ ও মোটা বালি দেড় ভাগ খুব মিহি করে একসঙ্গে মেশালে দোআঁশ মাটি তৈরি হয়ে যাবে। আর এর সঙ্গে এক ভাগ অন্তত এক বছরের পুরনো গোবর সার অথবা ভার্মি কম্পোস্ট মেশালেই তাতে মোলায়েম ব্যাপারটা এসে যাবে। সেই সঙ্গে আসবে অসংখ্য পুষ্টিগুণ। এই মাটি পলিব্যাগে ভরে তলায় চারদিকে দুটো করে মোট আটটা ফুটো করে দেবেন, যাতে বাড়তি জল বেরিয়ে যেতে পারে। আর টবের ক্ষেত্রে ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে টবে মাটি ভরবেন। তারপর মধ্যিখানে একটি ছোট্ট গর্ত করে তাতে এক চিমটে ফাঙ্গিসাইড দিয়ে চারাটি বসিয়ে দেবেন। ফাঙ্গিসাইড জীবাণুর আক্রমণে চারার গোড়া পচে যাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা দূরে রাখবে। এভাবে চারা বসানোর পর যথেষ্ট জল দিয়ে তিনদিনের জন্য গাছশুদ্ধ পলিব্যাগ বা টবকে শেডে রাখতে হবে। তারপর দু’দিন সেমিশেডে। তারপর ফুল সানলাইটে। এই পর্বে মাটি শুকিয়ে আসছে, এমন অবস্থা হলে জল দেবেন, নইলে নয়। তবে জল শুকোনোর সম্ভাবনা এই পর্বে থাকে না।

এটা ঠিক যে, টমেটো জল পছন্দ করে। কিন্তু গোড়ায় জল জমা একদম পছন্দ করে না। তাই খেয়াল রাখতে হবে যে, মাটি কখনই খটখটে শুকনো হবে না, সবসময় কাদাকাদাও থাকবে না। বুঝে জল দেবেন। জমিতে বা উঠোন বাগানে চাষ করলে যে-সব পোকাদের আক্রমণ হয়ে থাকে, তাদের তেমন আক্রমণ ব্যালকনি বা ছাদবাগানে টমেটো চাষ করলে দেখা যায় না। ফলে এই চাষ অন্তত তাদের হাত থেকে নিরাপদ। এবার হাতে থাকে ছত্রাকজনিত রোগ। তাদের আটকাতে কুড়িদিন অন্তর এক লিটার জলে এক চিমটে ফাঙ্গিসাইড গুলে স্প্রে করে যাবেন। দেখবেন, এতে গাছ ও মাটি দুই-ই যেন ভালোভাবে ভেজে। আর জাব পোকা যদি কোনভাবে এসে ধরে তাহলে এক লিটার জলে এক চিমটে সাবান গুঁড়ো বা সামান্য শ্যাম্পু গুলে পর পর দু’দিন সকালে স্প্রে করে দিলেই নিকেশ হয়ে যাবে।

এবার আসি খাবারের প্রসঙ্গে। টমেটো গাছকে খাবার দেওয়া শুরু করবেন তখনই, যখন দেখবেন সে খানকয়েক নতুন পাতা মেলেছে, পাশ থেকে নতুন ডাল ছাড়তে শুরু করেছে। খাবার দেওয়ার তিনটে পদ্ধতির কথা বলি, যেটা আপনার সুবিধে মনে হবে, সেটা ফলো করবেনঃ

এক, সপ্তাহে একবার তিনদিনের খোল পচা জল পাতলা করে দিতে হবে। শুধু বৃষ্টির মরসুমে বন্ধ রাখতে হবে। নইলে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হবে। আর প্রতি দশ দিন অন্তর প্রতি টব বা ব্যাগে পাঁচ-ছ’দানা করে ডিএপি গাছের গোড়া থেকে দূরত্ব বজায় রেখে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে।

দুই, এক সপ্তাহে তিন দিনের খোলপচা জল পাতলা করে দিলেন, তো পরের সপ্তাহে পনেরো দিনের সবজি পচা জল পাতলা করে দিলেন। এভাবেই চলতে থাকবে। এ-খাবার দেওয়া শুধু বৃষ্টির মরসুমে বন্ধ রাখতে হবে। নইলে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হবে।

তিন, প্রতি বারো বা পনেরো দিন অন্তর পনেরঃপনেরঃপনের ও দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ রাসায়নিক সার এটা একবার তো, ওটা একবার—এইভাবে দিতে থাকবেন। প্রতি টবে বা ব্যাগে এক চা-চামচের মতো করে প্রতিবার দিলেই হবে।

এবার বলি এক্সট্রা পরিচর্যার কথা। টমেটো গাছ ঝাঁকড়া হয় খুব দ্রুত, বাড়েও সেভাবে। তাতে তার যে ভার বেড়ে ওঠে, সেটা সামলানোর মতো ক্ষমতা তার শরীরে থাকে না। তাই এই গাছের খুব ঠেকনার দরকার পড়ে। বিভিন্নভাবে খুঁটি দিয়ে বেঁধে তাকে সুরক্ষিত রাখাটা খুব জরুরি; নইলে ভারের ঠেলায় শুয়ে পড়তে পারে বা এক্কবারে গোড়াশুদ্ধু ভেঙেও সে পড়ে যেতে পারে। ব্যালকনিতে সুবিধে থাকলে গ্রিলের সঙ্গে তাকে সেট করে দিতে পারেন। যাই হোক, যেভাবেই হোক গাছ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বিভিন্নভাবে সাপোর্ট দিতে শুরু করে দেবেন।

আর একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবেন, টব বা পলিব্যাগের মাটিতে কিছুতেই আগাছা হতে বা বাড়তে দেবেন না। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে স্টিলের শক্ত কাঁটাচামচ ব্যবহার করে ধীরে ধীরে টব বা ব্যাগের মাটি ধীরে ধীরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আলগা করবেন। এটা সম্ভব হলে সপ্তাহে দু’বার, নইলে অন্তত রোববার ধরে একবার করবেন। এতে মাটিতে যেমন আগাছা জন্মে বাড়তে পারে না, তেমনি মাটির ভেতর হাওয়া চলাচল করে গাছ ও মাটি দুয়েরই স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাছাড়া এটা মাটিতে ফাঙ্গাসের বিস্তার ঘটতেও বাধা দেয়। এই মাটি খোঁচানোর সময় মাসে একবার দুই থেকে তিন মুঠো গোবর বা কম্পোস্ট সার টবে বা ব্যাগে ছড়িয়ে দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দেবেন। রাসায়নিক সার ব্যবহারে মাটিতে রুক্ষ্মতা আসে, সেটা এই ট্রিটমেন্টে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়। মাটির মোলায়েম ভাব বজায় থাকে। এবং গাছের জন্য জৈব আহারেরও কিছুটা যোগান হয়।

অন্যান্য সবজির তুলনায় টমেটোতে ফুল আসতে, ফুল থেকে ফল হতে, সেই ফল বড় হতে এবং তা পেকে উঠতে একটু বেশিই সময় লাগে। তাই একটু ধৈর্য তো রাখতেই হয়। সেটা অবশ্য অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গেই রাখা যায়। কেননা, এ গাছ এমন সতেজ, সরস এক গাছ; যার সান্নিধ্যে মন ভরে যায়। এ-গাছের শিশির ভেজা রূপের সামনে এসে দাঁড়ালে প্রতিটি সকাল সুন্দর মনে হয়। এ গাছ এমন গাছ—যার পাতায়, গায়ে সবেতেই ফলের গন্ধ। তারপর হলুদ হলুদ ক্ষুদে ক্ষুদে ফুল, থোকা থোকা ফল। সব সুন্দর। কাঁচা টমেটো; সবুজ, সতেজ, পুষ্ট। তাকে যে পাকাতেই হবে, এরও কোন মানে নেই। সবজি হিসেবে দেদার খাওয়া যাবে কিছু। আর যেগুলো পাকবে, তাদের অপূর্ব লালিমাময় সৌন্দর্য আর স্বাদ ভোগ করা যাবে নানাভাবে। বাঙালির হেঁশেলে রাঁধা না-রাঁধার রেসিপিতে টমেটোগাথার অন্ত নেই যে...            

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...