মঞ্চে ম্যাজিক দেখাতেন। নিজে একটা কথাও বলতেন না। কথা বলত তাঁর হাত। নিতান্ত অরসিকের সাধ্য নেই অন্য দিকে কান দেয় বা নজর ঘোরে অন্য দিকে। ঘেঁটি ধরে বসিয়ে রাখতে পারতেন ঘন্টার পর ঘন্টা।
এমনই তাঁর ক্ষমতা। তিনি যে ঢোল সম্রাট!
বলরাম হাজরা। এই নামের কাছে আনত নয় গোটা লোক শিল্পী জগৎ তো বটেই তাবদ তালবাদ্য শিল্পীকুল।
তাঁদের কথায়, " বলরাম ওস্তাদের বাজনা না শুনলে জীবন বৃথা"। যে শুনেনি সে জানে না কী হারালো!
যাঁকে ঘিরে এমন মুগ্ধতার ঢেউ তিনি কিন্তু আশ্চর্য নির্লিপ্ত এক মানুষ। শুধু বোল আর ঢোল এই ছিল তাঁর জীবন।
আলিপুর দুয়ারের উত্তর পাটকাপাড়া গ্রাম।
সবুজ আর সবুজ। বাতাসে কচি চা পাতার গন্ধ। আদিবাসী এলাকা। প্রখর দারিদ্র্য।
বাবা ছিলেন সরকারী চৌকিদার। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায় ঘরে। এমন অবস্থায় স্কুল বই, পড়াশোনা যে বিলাসিতা।
তাই বাধা পড়ল পড়াশোনায়। কিছুটা যেন জীবনের দায়েই হাতে তুলে নিয়েছিলাম বাজনা। রক্তে সুর সবে বইতে শুরু করেছে।
বিয়ে-শাদী, শুভ কাজে ঢোল বাজাতেন। তৈরি হচ্ছিল হাত। ঢোল বাজিয়ে হিসেবেই চাকরি পেলেন এক তামাক সংস্থায়। ঘুরে ঘুরে বাজিয়ে প্রচার করতেন সংস্থার হয়ে। বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দিতেন।
তারপর একদিন যোগ দিলেন যাত্রা দলে। পালা চলার সময় বাজাতেন। সেভাবেই কলকাতার যাত্রাদলের কর্মী। অনেক দিন পর্যন্ত বাঁধা বাজিয়ে হিসেবে ছিলেন।
জীবনে এসেছে নানা পর্ব। নানা পর্যায়। যাত্রা থেকে ভাওয়াইয়া গানের দলে। উত্তর বঙ্গের প্রখ্যাত লোকশিল্পী সুখবিলাস বর্মনের সঙ্গে বাজাতেন। তারপরই খুলে যায় বিশ্ব মঞ্চের দরজা। বাজনার টানে রাজ্যে-রাজ্যে। দেশে-দেশে। তখন তাঁর চরকি জীবন। সুর আর বোল। বোল আর সুর।
ধিকানি-দাদি-ধিকানি-দাদি...এই বোলই মন্ত্র...
কথা বলতেন ঢাক দিয়ে। যেভাবে বলাতেন সেভাবেই সে বলত।
অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন জীবনে। কিন্তু অপরিসীম দারিদ্র্য পিছু ছাড়েনি কিছুতেই। বৃদ্ধ বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় অর্থ।
শেষ পর্যন্ত জাদুকরের জাদু থেমে যায় কর্কট রোগেই।