প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াকে ঘিরে বেশ কয়েকটি উপসাগর রয়েছে। সেগুলি হল সুলু, সেলেবিস, বান্দা, মালুকু, জাভা, ফ্লোরেস এবং সাভু। উপসাগরগুলির নীল জলে ঘুরে বেড়ায় বাজাউ নামক এক উপজাতি। এদের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। তাই এদের বলা হয় 'সি জিপসিস' বা 'সি নোমাডস'। শুনলে অবাক হবেন, সমুদ্রের তলায় অগভীর এলাকায় নদীতীর থেকে আধ কিলোমিটার সমুদ্রের ভেতরে বাজাউরা তৈরী করে তাদের অস্থায়ী গ্রাম। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরী করা বাড়িগুলিকে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খুলে ফেলা যায়। ছোট ছোট ডিঙির মত নৌকা করে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাতায়াত করা যায়। জলের ওপর বানানো হলেও ঘরগুলি হয় পোক্ত। ২০০৪ সালে যে সুনামি হয়েছিল, তাতে বাজাউদের কোনো ক্ষতি হয়নি। তাদের বাড়ির নিচ দিয়ে সুনামি গেছে।
এরা স্বভাবে যথেষ্ট শান্ত এবং আমুদে হয় ও সম্পূর্ণ সামুদ্রিক খাবারের ওপর বেঁচে থাকে। জলের নিচে তারা জলের ওপরের মতোই সাবলীল। ছোট ছোট বাজাউ শিশুরাও সমুদ্রের তলায় অক্লেশে মাছের মতই সাঁতার কেটে বেড়ায়। সকাল সকাল বাজাউ পুরুষেরা কোমরে পাথর বেঁধে কাঠ ও ফেলে দেওয়া কাঁচ দিয়ে নিজেদের অপটু হাতে তৈরী করা জলনিরোধক চশমা পরে জলের তলায় নামে। সঙ্গে নেয় নিজেদের বানানো অদ্ভুত দর্শন কাঠের বন্দুক। যা দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে তীর ছোঁড়া যায় জলের নিচে। এরা জলের নিচে প্রায় ১০ থেকে ১৩ মিনিট শ্বাস ধরে রাখতে পারে। যা বিশ্বের আর কোনো উপজাতি পারেনা। বিভিন্ন মাছ, স্টিং রে, স্কুইড, অক্টোপাস প্রভৃতি শিকার করে এবং উঠে আসার সময় শরীরে বাঁধা ওজন খুলে ফেলে শরীরকে হালকা করে নেয়।
এই উপজাতিদের নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক মেলিসা ইলার্দো ও রাসমুস নিয়েলসেন বাজাউদের নিয়ে করা এক গবেষণায় জানিয়েছেন, বাজাউরা যখন শ্বাস বন্ধ করে জলে ডুব দেয়, তখন তাদের দেহে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন দেখা দেয়। হৃৎপিন্ড তার কাজ কমিয়ে দেয়। পালস রেট নেমে দাঁড়ায় প্রতি মিনিটে মাত্র ৩০ বার। শরীরের বাইরের দিকের কলাকোষ থেকে রক্তপ্রবাহের অভিমুখ ঘুরে যায় শরীরের ভেতরের দিকে। রক্ত যায় মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড এবং ফুসফুসে। ডুবন্ত বাজাউদের প্লীহা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে রক্তের স্রোতে অক্সিজেন যুক্ত লোহিত রক্ত কণিকার যোগান বাড়িয়ে দেয়। পরীক্ষার সমস্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে গবেষকরা সিদ্ধান্তে আসেন যে, বহু বছর ধরে খাদ্য সংগ্রহের জন্য সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার অভ্যাস, বাজুদের বিভিন্ন অঙ্গ, শ্বসনতন্ত্র এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাই এরা সমুদ্রে মাছের মতোই সাবলীল।
বাজাউরা নিজেদের বয়স বলতে পারেনা। এই যুগেও তাদের তারিখ সম্পর্কে ধারণা নেই। ঠিক তেমনিভাবেই তারা জানেনা, বিদ্যুৎ কি এবং তা কী কাজে লাগে। সামুদ্রিক মাছের তেলের মশাল আজও তাদের রাতের অন্ধকার কাটায়।