সতীপীঠঃ বৈদ্যনাথধামের জয়দুর্গা মায়ের উপাখ্যান

দেওঘরের প্যাঁড়াগলি দু’পাশের সারি সারি দোকানের সুবাসিত ও অপূর্ব সুস্বাদে ভরা প্যাড়ার সম্ভার পেরোলেই এক প্রাচীন পুণ্যতীর্থ, বৈদ্যনাথ। উৎকলের জগন্নাথক্ষেত্র পুরী, মহাপ্রভুর নবদ্বীপ, কৃষ্ণক্ষেত্র বৃন্দাবন যেমন প্রতিটি ধর্মপ্রাণ হিন্দু-বাঙালিকে বারে বারে টানে; তেমনি অমোঘ এক আকর্ষণে টানে বৈদ্যনাথধাম। তন্ত্র ও পুরাণে উল্লিখিত মান্য সতীপীঠগুলোর মধ্যে বৈদ্যনাথধামের মাহাত্ম্য আলাদা, বৈশিষ্ট্যও আলাদা। কেন আলাদা? বলছিঃ

ভারতবর্ষের প্রতিটি কোনায় এবং ভারতবর্ষের বাইরে যে সমস্ত সতীপীঠ রয়েছে, সে-সমস্তই বিখ্যাত দেবীর নামে। শক্তিই সেখানে প্রধান। ভৈরব শিব তার কোনটিতেই প্রধান নন। অথচ বৈদ্যনাথধামে ভৈরব-শিব ‘বৈদ্যনাথ’ই প্রধান, তাঁর নামেই তীর্থের নাম। তাঁর টানেই মূলত ভক্তেরা এই তীর্থে ছুটে আসেন। এখানে দেবী সতী বা শক্তির নাম, ‘জয়দুর্গা’। তন্ত্র ও পুরাণ বলেন যে, দেবী সতীর হৃদয় এই তীর্থে পতিত হয়েছিল।

বৈদ্যনাথে শিব প্রধান ঠিকই, কিন্তু সতীপীঠ হিসেবেও এই তীর্থের জুড়ি নেই। কেননা, আমরা সর্বত্রই দেখেছি যে, অন্যান্য সতীপীঠ জাগ্রত হয়েছে ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবভক্তের দ্বারা। কিন্তু বৈদ্যনাথে দেবী শক্তিকে জাগ্রত করেছেন স্বয়ং তাঁর ভৈরব শিব। তাই সমগ্র একান্নপীঠের মধ্যে এই পীঠের তুলনা নেই। শিব কীভাবে এখানে প্রধান হলেন এবং কীভাবে তিনি এখানে দেবীকে জাগ্রত করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন, এবার সেই কথাই বলবঃ

কাহিনিটি আসলে কিছুটা কিংবদন্তি, কিছুটা পৌরাণিক। সেই কাহিনি অনুযায়ী শিব যখন সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নাচে সমস্ত সৃষ্টি নষ্টের লীলায় মত্ত; তখন তাঁকে সেই লীলা থেকে বিরত করতে বিষ্ণু সুদর্শন দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড বিখন্ড করে সতীকে শিবের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন। তাতে তাণ্ডব থামলেও শিবের হৃদয় শান্ত হল না। কেননা, সতী যে তাঁর অন্তরের ধন। হৃদয়ের ভেতরে আর একটা হৃদয়। তাই সতীর বিরহে বিবাগী-পাগল হয়ে গেলেন শিব। এই অবস্থায় একদিন শিব ঘুরতে ঘুরতে এলেন সেই ভূমিতে, যেখানে সতীর হৃদয় পতিত হয়েছিল। পরে এই স্থানের নাম হয়, ‘হৃদয়ভূমি’।

যাই হোক, হৃদয়ভূমিতে এসে শিব আবিষ্কার করলেন সতীর হৃদয়। আবার বিরহে ডুবলেন। কান্নায় ভাঙলেন। তারপর এক সময় নিজেই নিজেকে সংযত করে সেই হৃদয় চিতা রচনা করে সৎকার করলেন। হৃদয় ভস্ম হল। কিন্তু তবুও হৃদয় শান্ত হল না। তখন তাকে ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষায় সেই চিতাভস্মের ওপর বসে শিব শুরু করলেন সাধনা। তাঁর দীর্ঘ অটুট সাধনায় চিতাভস্ম থেকে ফের জাগ্রত হল সতীর হৃদয়। এক দৈবী জ্যোতিতে তা দৃশ্যমান হল। সেই জ্যোতিকে বক্ষে ধারণ করতেই দুই হৃদয়ের যোগ ঘটল, আর অমনি শিবের অশান্ত হৃদয় শান্ত হল। এইভাবেই বিরহী শিবের শান্তিক্ষেত্র হয়ে উঠল এই হৃদয়ভূমি। হয়ে উঠল নিত্যবিচরণের পুণ্যতীর্থ।

তারপর কেটে গেল বহু বহু কাল। সতী পার্বতীরূপে হিমালয়ের ঘরে জন্ম নিয়ে শিবের ঘরণী হলেন একদিন। ত্রেতা যুগ এল। ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও জন্মদোষে স্বভাবে রাক্ষস হলেন রাবণ। তিনি হয়ে উঠলেন অসাধারণ এক বীর যোদ্ধা। বাহুবলে তপোবলে অধিকার করলেন ত্রিলোক। তাঁর পুরী হল স্বর্ণময়।

রাবণ শুধু রাক্ষস নন, ব্রাহ্মণ সন্তান নন, নিছক হিংসার পূজারীও নন; তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে পারদর্শীও ছিলেন। আর ছিলেন আদি দেবদেবীর ভক্তও। শাস্ত্রজ্ঞান থেকেই রাবণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, সোনার লঙ্কায় যদি দেবাদিদেবের মন্দির তৈরি করে পূজা করা হয়, তাহলে সেই স্বর্ণরাজ্য কেউ কোনদিন জয় করতে পারবে না। ফলে, সেই সঙ্গে তিনিও অপরাজেয় থেকে যাবেন চিরদিন।

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। রাক্ষসদের কোনকিছুতেই বিলম্ব সহ্য হয় না। এতেও হল না। তিনি স্বয়ং শিবকে তুষ্ট করে তাঁকে এনে সোনার লঙ্কায় অধিষ্ঠিত করতে পায়ে হেঁটেই রওনা দিলেন কৈলাসের উদ্দেশ্যে। রাবণ যেমন অতুল ভোগবিলাসে জীবন কাটাতে জানেন, তেমনি জানেন কৃচ্ছ্রসাধনা করতেও।

হাঁটতে হাঁটতে তিনি হাজির হলেন একদিন কৈলাসে। এগোলেন শিবপীঠের দিকে। কিন্তু তাঁর পথ রোধ করলেন স্বয়ং বৃষভ নন্দী। নন্দী রাবণকে চিনতেন না, তাই এই বাধা। ইষ্টের পথে এই বাধা রাবণ কিছুতেই মানবেন না, নন্দীও কিছুতেই পথ ছাড়বেন না। ব্যস, তাতেই ক্রুদ্ধ হয়ে অমিতবল রাবণ নন্দীকে তুলে ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। তাতে আহত নন্দীও ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে রাবণকে শাপ দিলেন, তাঁর চেয়েও হীন জীব বানরের সহায়তায় একদিন রাবণের রাজ্য-বংশ সব ছারখার হবে!

অভিশাপের দিকে রাবণের মন ছিল না। কতক্ষণে তিনি শিবকে নিয়ে গিয়ে লঙ্কায় প্রতিষ্ঠা করবেন—এই ভাবনাতেই অস্থির হয়ে ছিলেন। তাই একেবারে সোজা শিবের পীঠে হাজির হলেন। কিন্তু সেখানে তাঁকে দেখতে না-পেয়ে অধীর হয়ে রাবণ সমগ্র কৈলাস পর্বতকেই উপড়ে কাঁধে তুলে নিলেন সঙ্গে নিয়ে যাবেন বলে। কেননা, তিনি জানেন শিব কৈলাস ছেড়ে কোথাও যান না। থাকলে এখানেই কোথাও থাকবেন নিশ্চয়, লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে খুঁজে দেখলেই হবে—এই হচ্ছে তাঁর মনোভাব।

এদিকে কৈলাসের উপবনে শিব-পার্বতীর তখন চলছিল মান-অভিমানের পালা। পার্বতী যখন অভিমান করে শিবের কাছ থেকে সরে মুখ ফিরিয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন; ঠিক তখনই রাবণ কৈলাস পর্বত উৎপাটিত করলেন। অমনি তা উপবনসহ সবেগে কম্পিত হতে শুরু করল। এই অবস্থায় টাল সামলাতে না-পেরে পার্বতী মহাদেবের বুকে এসে পড়লেন। এবং শিব তাঁকে হাসতে হাসতে সোহাগে সবেগে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বুড়ো আঙুলের চাপে কৈলাসকে স্থির করলেন।

শিবের আঙুলের চাপে কৈলাসকে রাবণ নাড়াতে তো পারলেন না, এমনকি নিজেকেও তার তলা থেকে বের করতে পারলেন না। তবে নির্বোধ-স্পর্ধায় ভুল কাজ করেও শিব-পার্বতীর মিলনের কারণ হয়ে তিন মহাদেবের কৃপা পেলেন। মহাদেব তাঁকে দর্শন দিলেন। তাঁর কৃপায় পর্বতের তলা থেকে রাবণ বেরিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন, রাবণের এখানে আসার উদ্দেশ্য, কৈলাস উত্তোলনের কারণ।

রাবণের মুখে সব শুনে শিব মনে মনে হাসলেন। অত্যাচারী রাবণ অপরাজেয় হলে দেবতারা যাবেন কোথায়! কোথায় থাকবে ন্যায়! মুখে বললেন, দেখ বাপু, কৈলাস আমার পীঠভূমি, এ ভূমি ছেড়ে তো আমি যেতে পারব না। তবে তোমায় আমি আমার জ্যোতির্লিঙ্গমূর্তি দান করতে পারি, তা প্রতিষ্ঠা করে পুজো করলে তুমি যে প্রত্যাশা নিয়ে এখানে এসেছ তা-ই পূরণ করতে পারবে।

এ-কথা শুনে রাবণ বেশ খুশি হয়ে জ্যোতির্লিঙ্গমূর্তি নিতে সম্মত হলেন। শিব মুচকি হেসে তাঁর হাতে সেই মূর্তি তুলে দিলেন। বললেন, মূর্তি হাতে নিয়েছ বটে, কিন্তু সাবধান লঙ্কায় পৌঁছবার আগে কোথাও হাত থেকে নামিয়ে ফেলো না যেন; তাহলে আর তা কিছুতেই উত্তোলন করতে পারবে না! তখন আমায় সেখানেই ছেড়ে তোমায় ফিরে যেতে হবে।

রাবণ তাতে সম্মতি জানিয়ে মহাদেবের চরণ বন্দনা করে বিদায় নিলেন।

এদিকে দেবতারা ব্যাপারটা দেখে তো আতঙ্কে অস্থির। রাবণ অপরাজেয় হয়ে উঠলে যে তাঁদের সমূহ বিপদ। জীবনেও স্বর্গরাজ্য উদ্ধার হবে না। তাই জ্যোতির্লিঙ্গ নিয়ে রাবণকে কিছুতেই লঙ্কায় পৌঁছতে দেওয়া যাবে না। পথেই তা কোথাও নামিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। এ-কাজে সাহায্যের প্রার্থনা নিয়ে তাঁরা হাজির হলেন ভগবান বিষ্ণুর কাছে। তাঁদের প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু দিলেন সাহায্যের আশ্বাস।

বিষ্ণু ভাবলেন জ্যোতির্লিঙ্গ তো আর যেখানে-সেখানে প্রতিষ্ঠা করলে হবে না, তার জন্য পবিত্রভূমির প্রয়োজন। যেখানে ভাবীদিনে গড়ে উঠবে দেবালয়, গড়ে উঠবে তীর্থ।

বিষ্ণু যখন এই সব ভাবছেন, তখন জ্যোতির্লিঙ্গ নিয়ে রাবণ পা রেখেছেন সেই হৃদয়ভূমিতে। আহা, বিষ্ণু সচকিত হলেন, এর চেয়ে ভালো ভূমি যে আর ভূ-ভারতে নেই! এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ স্থাপন করলে শিবশক্তির অপূর্ব সমাবেশ হবে। সুতরাং, এখানেই জন্ম দেওয়া যাক এক নতুন লীলার।

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। বিষ্ণুর মায়ায় রাবণের এল প্রচণ্ড প্রস্রাবের বেগ। কিছুতেই সেই বেগ তাঁর পক্ষে সামলানো দায় হয়ে উঠল। কিন্তু জ্যোতির্লিঙ্গ হাতে নিয়ে তো আর বেগমুক্ত হওয়ার উপায় নেই; নামিয়ে রাখাও যাবে না! তাহলে উপায়?

ঠিক এমন সময় ব্রাহ্মণের বেশ ধরে সেখানে হাজির হলেন স্বয়ং বিষ্ণু। তাঁকে দেখে হাতে যেন চাঁদ পেলেন রাবণ। তাঁর হাতে জ্যোতির্লিঙ্গ দিয়ে মাটিতে না-নামানোর সাবধান বাণী শুনিয়ে তবেই গেলেন বেগমুক্ত হতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, রাবণ পিছন ফিরতেই জ্যোতির্লিঙ্গ মাটিতে নামিয়ে মন্ত্র সহকারে স্বয়ং বিষ্ণু তাঁকে প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন তাঁর উদাত্ত মন্ত্রে, আন্তরিক স্তবে তুষ্ট হয়ে মহাদেব পাতাল অব্দি সেই লিঙ্গরূপ বিস্তৃত করে লোকহিতের জন্য ঊর্ধ্বে মাত্র আট আঙুল পরিমাণ জেগে রইলেন।

মহাদেবকে প্রতিষ্ঠা করে বিষ্ণু অদৃশ্য হলেন। রাবণ বেগমুক্ত হয়ে ফিরে এসে ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত জ্যোতির্লিঙ্গ দেখে নিষ্ফল ক্রোধে আস্ফালন করে তাঁকে ওঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত শূন্য হাতে লঙ্কায় ফিরে গেলেন। মধ্যিখানে জন্ম হল এক অপরূপ শাক্ত-শৈবতীর্থের।

সেদিন এভাবেই দেবী সতী ও পতি শিবের মিলন হল এই তীর্থের আঙিনায় এসে। হৃদয়ে হৃদয়ের যোগ অচ্ছেদ্য হল। বৈদ্যনাথের মন্দির প্রাঙ্গণে গেলে সেই যোগ পার্থিবরূপেও চোখে পড়ে। বৈদ্যনাথের মন্দিরের চূড়ার সঙ্গে জয়দুর্গা মন্দিরের চূড়া লাল কাপড়ের ফালি দিয়ে যুক্ত। এ যেন তাঁদের সেই হৃদয়যোগেরই প্রতীক। এ সেই তীর্থ, যেখানে ভক্তের হৃদয়বাসনা ইষ্টের হৃদয়ের আশীর্বাদে পূর্ণ হয়। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও আপামর ভক্তের প্রিয় কাম্যতীর্থ হয়ে রয়েছে এই হৃদয়ভূমি বৈদ্যনাথধাম...        

    

                      

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...