পূর্ব সিকিমে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকেরা নিশ্চয়ই বাবা হরভজন সিংহের মন্দির দেখেছেন৷ সিকিমের পার্বত্য এলাকায় ভারত-চীন সীমান্তে নাথুলায় রয়েছে বাবা হরভজন সিংহের মন্দির৷ ভক্তদের বিশ্বাস এখনও এই মন্দিরেই রয়েছেন বাবা হরভজন সিংহ। ভারত-চীন সীমান্তে পাহারার দায়িত্ব ছিলেন হরভজন সিংহ, ১৯৬৮ সালে নাথুলাতেই কর্মরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। মাত্র ২৭ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন এই বীর। ভারত ও চীন সীমান্তে প্রহরার দায়িত্বে থাকা ভারতীয় সেনাদের বিশ্বাস মৃত্যুর এত কাল পরে আজও সীমান্ত পাহারা দিয়ে চলেছেন বাবা হরভজন সিংহ।
ভারতীয় সেনার বিশ্বাস, যেকোন দুর্যোগের আগে থেকে সেনাদের সতর্ক করেন বাবা হরভজন সিংহ৷ নাথুলার ভারত-চীন সীমান্তে যখনই পতাকা উত্তোলন হয়। এক পাশে হরভজন সিংহের চেয়ার রাখা থাকে। ভক্তদের বিশ্বাস সেখানে এখনও আসেন বাবা। আজও প্রত্যেকদিন সকালে নিয়ম মেনে পরিষ্কার করা হয় বাবা হরভজন সিংহের ঘর৷ সেই ঘরে এখনও রাখা রয়েছে হরভজন সিংয়ের পোশাক, জুতো ও অন্যান্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র। এখনও তাঁর নামে বেতন জমা পড়ে। বছরে ২ বার ছুটিও বরাদ্দ হয় তাঁর নামে, জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনের টিকিট কেটে, এক সেনাকে সঙ্গে দিয়ে তাঁর ছবি বাড়িতে পাঠানো হয়।
তিনি হয়ত নেই, আবার হয়ত তিনি আছেনও। বাস্তবে না থেকেও তিনি দেশের সীমান্তে পাহারার দায়িত্ব সামলেচলেছেন। এমনই বিশ্বাস করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেনাদের কাছে হরভজন সিংহ দেবতা। মৃত্যুর বহু বছর পরেও তিনি দেশের সীমান্তকে বিপদ থেকে রক্ষা করে চলেছেন। ১৯৪১ সালে পঞ্জাবে ১৩ মে জন্ম হয়েছিল হরভজন সিংহের। আবার কেউ কেউ বলেন তাঁর জন্ম ১৯৪৬ সালের ৩০ আগস্ট। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক পাঠের পরে তিনি পঞ্জাবের ডিএভি হাইস্কুল থেকে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৫ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পঞ্জাব রেজিমেন্টে যোগ দেন হরভজন।
১৯৬৮ সালে ২২ বছর বয়সি হরভজন কর্মরত ছিলেন নাথুলায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় দুর্গম গিরিপথ সবসময়েই স্পর্শকাতর। একাধিকার শত্রু আক্রমণ, হামলা দেখে ফেলেছে নাথুলা। বীর সন্তানের রক্তে রেঙেও উঠেছে। সীমান্তবর্তী এই অংশেই মালবাহী পশুর পিঠে পণ্য নিয়ে হরভজন সিংহ রওনা দিয়েছিলেন প্রত্যন্ত ও দুর্গম আউটপোস্টের পথে। সেখানে রসদের অপেক্ষায় ছিলেন অন্য সেনা জওয়ানরা।
১৯৬৮ সালের অক্টোবর, বৃষ্টি ও ধসে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আরও প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল নাথুলা। তার মধ্যেই রওনা দেন হরভজন সিংহ। কিন্তু গন্তব্যে আর পৌঁছনো হয়নি। পশুগুলিকে তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকটি ফিরে আসে। হরভজন সিংহের সহকর্মীরা বুঝতে পারেন, হরভজনের কোন বিপদ হয়েছে। শুরু হয় তল্লাশি। তিন চার দিন ধরে নির্ধারিত যাত্রাপথে খোঁজ করেও হরভজনের কোন সন্ধান পায় না সেনারা।
জনশ্রুতি রয়েছে, এরপর নিহত হরভজন স্বপ্নে এসে নিজেই বলে দেন, তাঁর দেহ কোথায় পাওয়া যাবে। শোনা যায়, তিনি নাকি সেনা জওয়ান প্রীতম সিংহকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিল। হরভজনের বলে দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গাতেই তাঁর নিথর দেহ উদ্ধার হয়েছিল। যদিও তাঁর মৃত্যুর কারণ জানা যায় না। সামরিক মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এরপরেই শুরু হয় অলৌকিক ঘটনা।
মৃত্যুর পরেও নিজের কর্তব্যে অবিচল হরভজন। শত্রুপক্ষ থেকে আসা আগাম বিপদের ব্যাপারে আগে থেকেই তিনি সতর্ক করেন সেনা জওয়ানদের। এমনকি, শোনা যায়, কোন সেনার পোশাক সামান্যও অবিন্যস্ত থাকলে তাঁর গালে এসে পড়ে সপাট থাপ্পড়! হরভজন সিংহের সামরিক উর্দি, জুতো এখনও সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা। পরিপাটি করে রাখা হয় তাঁর ব্যবহৃত বিছানাও। কিন্তু নাথুলায় পাহারারত জওয়ানদের দাবি, মাঝে মাঝেই সেই পরিপাটি এলোমেলো হয়ে যায়। তাঁদের বিশ্বাস কাজের মাঝে হরভজন সিংহ নিজেই এসে বিশ্রাম নেন সেখানে। তিনি যে আজও সীমান্তে টহল দেন, সে প্রমাণ নাকি পাওয়া যায়। তাঁর জুতোজোড়াতে মাঝে মাঝেই নাকি ধুলোকাদা লেগে থাকে। অথচ তাঁর সামরিক উর্দির পরিচ্ছন্নতা একচুলও নষ্ট হয় না। সিপাই হরভজন নিজেই তাঁর উর্দি পরিষ্কার রাখেন।
ঠিক করা হয়, মন্দির তৈরি করে তাঁর স্মৃতি রক্ষা করা হবে। তিনি মানুষ হয়েও দেবত্বের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছেন। সেনাকর্মী থেকে তিনি এখন বাবা হরভজন সিংহ। পূর্ণিমার রাতে বরফের মাঝে নাকি ঘোড়ার পিঠে টহল দিতে দেখা যায় তাঁর ছায়ামূর্তিকে। তাঁর উপস্থিতি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতে পেরে নাথুলায় অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হয়।
গ্যাংটক থেকে ৫২ কিমি দূরে, নাথুলা আর জেলেপ গিরিপথের মাঝে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ১২৩ ফিট উচ্চতায় রয়েছে বাবা হরভজন সিংহের মন্দির। পর্যটকরা সেখানে যান। এই মন্দিরের রীতি হল ভর্তি জলের বোতল রেখে আসার। সেই জলপান করলে নাকি পূর্ণ হয় মনের ইচ্ছে। শুধু পর্যটকরাই নন, ট্রাক থামিয়ে পুজো দেন সেনা জওয়ানরাও। তাঁদের কাছে হরভজন সিংহ পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় এবং রক্ষাকর্তা।
১২ বছর আগে পর্যন্ত প্রতি বছর বার্ষিক ছুটিও পেতেন বাবা হরভজন সিংহ। ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছত জিপ। হরভজন সিংহের নামে রিজার্ভেশন করা হত। ট্রেনের শূন্য বার্থে অন্য জওয়ানের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে যেতেন সিপাই হরভজন সিংহ, তাঁর সঙ্গেই যেত তাঁর জিনিসপত্র। ট্রেনে করে সেই জিনিস যেত পঞ্জাবের কপূরথালা জেলার কোকে গ্রামে। সেখানেই থাকেন তাঁর পরিজনরা। ছুটি ফুরিয়ে গেলে আবার ফিরে যান কাজের জায়গায়। তবে তাঁর বদলি হয় না। প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নাথুলায় কর্মরত। কিন্তু ১২ বছর হল তাঁর বাড়ি ফেরার রীতিটি বন্ধ হয়েছে। নিজের গ্রামে তিনি শহিদের মর্যাদা পান। সেনা এদেশের আবেগ, আর দেশের রক্ষক এইভাবেই ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন।