ছিলেন পোস্ট-আপিসের ক্লার্ক, হলেন ব্যারিস্টার। পেশাগত জীবনে সাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের এই পটপরিবর্তনের একটাই কারণ এবং তা হল, প্রেম। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলছি :
সাহিত্যিক ও ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য পত্রিকা 'ভারতী'র সম্পাদক স্বর্ণকুমারী দেবী এবং জানকীনাথ ঘোষালের কন্যা সরলা দেবী ভালোবেসেছিলেন প্রভাতকুমারকে। ভালোবাসার সূত্রপাত প্রভাতকুমারের লেখা গল্প পড়ে। ব্যাপারটা এতটাই অভিনব যে, সে-কালে সাহিত্যিকমহলে বেশ সাড়া পড়েছিল, চর্চা চলেছিল এবং ধন্য ধন্য রব উঠেছিল।
আসলে স্নাতক হয়ে এবং স্নাতকোত্তর পাঠের সময়পর্বে দেশসেবার কাজে স্বাদেশিকতা ও স্বনির্ভরতার মন্ত্র ছড়িয়ে দিতে জোরকদমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সরলা দেবী। সেই সঙ্গে চলছিল স্বনামে, অনামে এবং বেনামে 'ভারতী' পত্রিকায় লেখালেখি। তাতে রবীন্দ্রনাথের অকুণ্ঠ প্রশংসাও নিয়মিত প্রাপ্য হচ্ছিল। তারই মধ্যে সরলা ঠিক করেছিলেন যে, বিয়ে করবেন না, 'চিরকুমারী ব্রত' নিয়ে দেশের সেবা করবেন। কিন্তু, তাঁকে ব্রতভঙ্গের পথে টানল প্রভাতকুমারের গল্প।
স্বনামে কবিতা এবং বেনামে গল্প লিখে শুরু হয়েছিল প্রভাতকুমারের সাহিত্য-জীবন। 'প্রদীপ'-পত্রিকায় রাধামণি দেবী ছদ্মনামে তিনি দু'খানা গল্প লিখে রবীন্দ্রনাথের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেলেন। রবীন্দ্রনাথ বললেন : "ছোটগল্প লেখায় পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে তুমি যেন সব্যসাচী অর্জুন...।" এতে বেশ উৎসাহ পেয়ে গল্প রচনাকেই আপন সাহিত্যপথ বলে বেছে নিলেন প্রভাতকুমার।
স্বনামে গল্প লিখতে শুরু করলেন। হয়ে উঠলেন 'ভারতী' পত্রিকার বিশিষ্ট লেখকগোষ্ঠীর একজন। প্রভাতকুমার রবীন্দ্রযুগের গল্পকার হয়েও জীবনদৃষ্টি ও ভাষাশিল্পী হিসেবে ছিলেন একেবারেই রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত। এই সাহিত্যগুণটিই হয়তো সরলাকে টানল।
সরলার স্বভাবে সদগুণ বলুন বা অস্বাভাবিকতা, তাঁর মজারু প্রবৃত্তির সঙ্গে ছিল প্রসঙ্গে-অপ্রসঙ্গে-অসঙ্গতিতে যখন-তখন হেসে ওঠার প্রবণতা। এই যেমন ধরুন, ক্লাসে সিরিয়াস পড়া চলছে, তার মধ্যে তাল কেটে বাইরে কোথাও কা কা রবে বিচ্ছিরি রকমের সুরে কাক ডেকে উঠল; অন্য কেউ খেয়ালই করল না, কিন্তু তিনি খেয়াল করলেন এবং হেসে উঠলেন! তাই প্রভাতকুমারের লেখা গল্পমালার বেশ কিছুতে প্রবাহিত স্নিগ্ধ হাস্যরসের ছোঁয়াও সরলাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে সাহায্য করেছিল।
প্রেমের জোয়ারে দোহারে যখন ভাসছেন, তখন জানকীনাথ জানালেন যে, প্রেমে তাঁর আপত্তি নেই, বিয়েতেও না; আপত্তি শুধু প্রভাতকুমারের পেশায়। রক্তসূত্রে এবং যোগসূত্রে একরকম ঠাকুরবাড়িরই জামাই হতে চলেছেন প্রভাত। তাতে, ক্লার্কশিপটা ঠিক এ-বাড়ির যোগ্য জামাই হওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতা নয়।
বিলেত ফেরৎ হতেই হবে। প্রভাত যদি রাজি থাকেন তাহলে তিনি তাঁকে ব্যারিস্টারি পড়াবেন। প্রেম তখন তুঙ্গে। ফলে, প্রভাতকুমারের দু'বার ভাববার অবকাশ বা ইচ্ছে কোনটাই ছিল না। তিনি রাতারাতি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে শ্বশুরের কাঁধে ঝুলে কালাপানি পেরিয়ে গেলেন।
তিন-চার বছর কেটে গেল। প্রভাতকুমার পুরোদস্তুর ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরলেন। কিন্তু, সরলার সঙ্গে বিয়ে হল না। সাহিত্যিকমহলে আবার সাড়া পড়ল, চর্চা চলল কিন্তু উত্তর মিলল না। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চুপ রইলেন দুই পক্ষ।
পরে সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায় অনুমান করেছেন, "চোখের আড়াল হ'লে প্রাণের আড়াল হয়--বোধ করি সত্য হয়ে দাঁড়াল এই প্রবাদটাই।" যাই হোক, প্রেম পরিণাম পেল না। সেই ব্যর্থ প্রণয়ের এই ইতিহাসই কি পরে 'প্রণয় পরিণাম' নামের এক গল্পে মূর্ত হল? হয়তো।
'প্রণয় পরিণাম'-গল্পের কিশোর নায়ক মাণিক বালিকা কুসুমের প্রেমে পড়েছিল। পরিশেষে বাপের হাতে মার খেয়ে এবং কুসুমের বিয়ের মধ্য দিয়ে সেই প্রণয় ব্যর্থ হয়েছিল। প্রভাতকুমারের ভাষায় : "উপন্যাসের অনুকরণে প্রেমে পড়িয়াছিল। কিন্তু উপন্যাসের অনুসারে গৃহত্যাগ করিল না-বিষও খাইল না।
বিষ খাইল না বটে-তবে কুসুমের বিবাহের সময় লুচি খাইল বিস্তর। এত খাইল যে তাহার পরদিন অসুখ হইয়া পড়িল। সেই সুযোগে সপ্তাহখানেক স্কুলে গেল না।" ভাগ্যের মারে প্রণয়-ব্যর্থ প্রভাতকুমারও ব্যক্তিপ্রেমকে বস্তুপ্রেমের দিকে চালিত করেছিলেন। সাহিত্যচর্চায় আরও মগ্ন হয়ে সেই ব্যর্থতার বিষাদ কাটিয়ে উঠেছিলেন।
তাই, সরলা যখন সাহিত্য-সংশ্রব প্রায় ছেড়ে হঠাৎ রামজীবন দত্ত চৌধুরীকে বিয়ে করে পাঞ্জাবে চলে গেলেন; তখন অন্যদিকে প্রভাতকুমার ব্যারিস্টারির পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস রচনায় আরও ডুবে গেলেন।
ভাগ্যিস ডুবলেন, নইলে 'হতাশ প্রেমিক ও অন্যান্য গল্প' (১৯২৪), 'বিলাসিনী ও অন্যান্য গল্প' (১৯২৬), 'যুবকের প্রেম ও অন্যান্য গল্প' (১৯২৮), 'নূতন বউ ও অন্যান্য গল্প' (১৯২৯), এবং 'জামাতা বাবাজী ও অন্যান্য গল্প' (১৯৩১) প্রভৃতি রত্নের মতো অনন্য গল্পগ্রন্থাবলী বাংলা সাহিত্য হয়তো পেতই না, আমরাও বঞ্চিত হতাম...