পৌষ সংক্রান্তি উৎসবের অঙ্গ আউনি-বাউনি কী জানেন?

আউনি-বাউনি কোথাও না যেও,

তিন দিন ঘরে বসে পিঠেপুলি খেও!

পৌষমাসের শেষ পর্বে মকরের হাওয়া গায়ে লাগলেই এই মেঠো ছড়া গুণগুণ করে ওঠে মন। কুয়াশার পরদ সরিয়ে সকালের কাঁচা রোদ এসে পড়েছে উঠোনে। পুকুরের জলে টলটল করছে রোদ্দুর। ভেসে আসছে সকালের কীর্তন আর হেঁশেলে কলাপাতায় সাজিয়ে রাখা রাতের পিঠে। উনুনের নিভে যাওয়া আঁচে তখনও লেগে সামান্য উত্তাপ। মকর-দিনে গ্রাম দেশে এ খুব মনোরম ছবি। এখন খুঁজলে আর সে দৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী হয়ে ভাইরাল। এক ফোন থেকে অন্য ফোনে শেয়ার হতে হতে হারিয়ে যায় তার সহজ মাধুর্য।

তবে জেগে থাকে পিঠের স্বাদ। চাল, গুড় আর যৎসামান্য উপকরণ আর আগুনের তাত তৈরী পিঠে বাংলার সম্পদ। দুই বঙ্গের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে এমন অজস্র নাম। চাল-গুড়ের পিঠেরও যে এমন নান্দনিক নাম হতে পারে তা বাংলায় পা রাখলে জানা যায় না।

পিঠে তৈরী শুধু হেঁশেল জীবনের কৌশল নয়, পিঠে শিল্প। হাতের নিখুঁত নৈপুণ্য যেমন চাই, তেমনি তৈরীর প্রণালীটিও কঠিন। পিঠের কলাকৌষল কোনও ট্রেনিং নিয়ে, বা রান্নার ইস্কুলে রাতারাতি শিখে ফেলা যায় না। এই পিঠে তৈরীর কৌশলে প্রবাহিত হয় এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে।

পৌষমাসের শেষ দিনটি পৌষসংক্রান্তি। পৌষ পার্বণের মকর স্নান যেমন বিশেষ, বাঙালির কাছে পৌষ পার্বণের পিঠে পরব তেমনি বিশেষ। প্রাচীন সময়ে দিনটি ছিল ধান কাটার উৎসব। একসময় এই দিনটিতে পরলোকগত পূর্বপুরুষ বা বাস্তুদেবতার উদ্দেশে পিঠে-পায়েস নিবেদন করার প্রথা ছিল। তার ঠিক আগের দিন গ্রামবাংলার গেরস্তবাড়ির উঠোন পরিষ্কার করে নিকিয়ে সেখানে চালগুঁড়ি দিয়ে আলপনা দেওয়া হত। যার মধ্যে কুলো, সপ্তডিঙা মধুকর, লক্ষ্মীর পা, প্যাঁচা এবং অবশ্যই ধানের ছড়ার আলপনা বেশি প্রচলিত ছিল। এ-বাংলায় এই আচারটিকে লোকায়ত ভাষায় আউনি-বাউনি পুজোও বলে।

পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন পুজো করে দু’-তিনটি ধানের শিষ বা খড়, আমপাতা দিয়ে বিনুনি করে ‘বাউনি’ তৈরি করা হয়। অনেকে মাটির সরায় আসকে পিঠে বানিয়ে সেটিকে বেড় দিয়ে প্রথম বাউনি বানান। সেটিকে বাড়ির দরজা সহ বিভিন্ন জায়গায় বেঁধে রাখা হয়। বাঁধার সময়ই আওড়ানো হয় প্রচলিত ছড়া। বিশ্বাস করা হয়, এই ভাবেই ঘরের সৌভাগ্য চিরতরে বাঁধা পড়ে থাকবে। ‘আউনি বাউনি’ ছড়ার অর্থও খুঁজেছেন ভাষাতত্ত্ববিদরা। আউনির অর্থ লক্ষ্মীর আগমন, বাউনির মানে লক্ষ্মীর বন্ধন বা স্থিতি আর চাউনি হল দেবীর কাছে করা প্রার্থনা। সেদ্ধ পিঠে, পাটিসাপটা, সরুচাকলি বানিয়ে এই লোকাচার সম্পূর্ণ হয়।

এই আচার সম্পূর্ণ করার পর শুরু হয় পিঠে তৈরীর পর্ব। অতীতে পিঠে তৈরী করার আগে মহিলাদের শুদ্ধাচারের ওপর কড়া নজর দেওয়া হত। লোকবিশ্বাস ছিল সঠিক আচার না মানলে পিঠে ক্রুটিযুক্ত হবে।

তবে অতীতে হেঁশেল জীবন ঘিরে যে বিশ্বাস, প্রথাও লোকাচার কাজ করত তা হারিয়ে গিয়েছে সময়ের নিয়মে। মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে হাজার গুণ। সেভাবেই হারিয়ে গিয়েছে অনেক পিঠে। চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীর মুরলি, চন্দনপাতা এছাড়াও আছে নানা ধরনের নকশি পিঠে। নকশা অনুযায়ী বদলে বদলে গিয়েছে পিঠের নাম। তেমনি দুই নাম জামদানি আর মুখশৈলী পিঠে।

জামদানি শাড়ি সবার জানা, কিন্তু জামদানি পিঠেও হয়। কয়েক বছর আগে পর্যন্তও বাংলাদেশে তার চল ছিল। শীতের মরসুমে বাড়িতে অতিথি এলে পরিবেশন করা হত।    

জামদানি পিঠে

চাল গুড়ি দুধ বা জলে গুলে ব্যাটার তৈরী করে তা সিরিঞ্জ বা সরু নলের মধ্যে ঢুকিয়ে কলাপাতার ওপর চলত নানান নকশা। কড়া রোদে কয়েক দিন শুকিয়ে তবেই তা ঘরে তোলা হত। খাওয়ার আগে মুচমুচে করে ভেজে তার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হত চিনি।  

মুখশৈলী পিঠে

জলে খেজুর গুড় তেল আর সামান্য নুন দিয়ে গুলে ফুটিয়ে নিন। কড়াইতে ফুটে উঠলে ভাজা চালের গুঁড়া দিয়ে সেদ্ধ ব্যাটার বানান। গরম অবস্থায় হাতে ঘি ও দুধ দিয়ে খুব ভালোভাবে ময়ান দিতে হবে। মসৃণভাবে খামির বানান। হাতে ছোট ছোট বাটির মতো গড়ে তার ভিতর দেওয়া হয় ক্ষীর-নারকেলের পুর। তারপর তেলে ভেজে নেওয়া হয়। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...