মামাতো বোন হেমকুসুমকে ভালোবেসেছেন অতুলপ্রসাদ সেন, দু'জনে দু'জনকে ছাড়া বাঁচতেই পারবেন না। তাই বিয়ে করতে চান। কিন্তু, সে-কালের সমাজ-পরিবার-দেশীয় আইন কেউই তাঁদের এই বিয়েকে মেনে নিতে চাইল না। তবু এই প্রবল বিরোধীতার মুখেও তাঁরা পিছু হটলেন না।
এটা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের কথা। হিন্দু বা ব্রিটিশ দুই আইনেই মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের বিয়ে বৈধ নয়। ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হলে এ-সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু, অতুল সেটা করবেন না। তিনি স্বধর্মে থেকেই সমস্যার সমাধান চেয়ে আইনবিদ লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের দ্বারস্থ হলেন।
সত্যেন্দ্রপ্রসন্নর পরামর্শে হেমকুসুম ও অতুল পাড়ি দিলেন স্কটল্যান্ড। সেখানকার গ্রেটনাগ্রিন গ্রামে ভাইবোনের বিয়ে আইনসিদ্ধ। এখানে বিয়ে হলে আর কোথাও কোন সমস্যা হবে না। ফলে, সেখানে অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে দু'জনের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর ভাবলেন আত্মীয়রা যখন সমর্থন করেননি, আশীর্বাদ করেননি-তাহলে কেন দেশে ফিরবেন, কার জন্য! তাঁরা ঠিক করলেন বিলেতেই থেকে যাবেন।
থেকে গেলেন। লন্ডনে নতুন উদ্যমে ব্যারিস্টারি শুরু করলেন অতুল। না, প্র্যাকটিস জমাতে পারলেন না। কাজেই শুরু হল কষ্টের জীবন।
তবু জীবন থেমে রইল না। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে হেমকুসুম জন্ম দিলেন যমজ পুত্রসন্তানের। তাদের নাম দিলেন, দিলীপ কুমার আর নিলীপ কুমার।
দিন কাটতে লাগল। কিন্তু আর্থিক সঙ্কট কিছুতেই কাটতে চাইল না। তারই মধ্যে একদিন ভীষণ জ্বর এল নিলীপ কুমারের। স্বজনহীন প্রবাসে অতুলের সঙ্গতি হল না পুত্রের ঠিকমতো চিকিৎসা করানোর। সে-এক চরম অসহায় অবস্থা। সেই অবস্থায় কয়েকদিন জ্বরে ভুগে মাত্র সাত মাস বয়সে নিলীপ কুমার মারা গেলেন। তারই সঙ্গে অতুল ও হেমকুসুমের জীবনের সব আনন্দ যেন শেষ হয়ে গেল।
সেই প্রবাসী শূন্যতার মাঝে বন্ধু হয়ে এলেন এক দেবদূত। সেই দেবদূতের নাম, মমতাজ হোসেন। তিনি হাল ফেরাতে উত্তর প্রদেশের লখনৌতে অতুলকে ব্যারিস্টারি করতে পরামর্শ দিলেন। শুধু পরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, সবরকম সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।
তারই ফলে, ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অতুল-হেমকুসুম দিলীপ কুমারকে নিয়ে দেশে ফিরলেন। প্রথমে এলেন কলকাতায়। ভাবলেন, যদি ছিন্ন সুতো জোড়া লাগে। যদি আত্মীয়েরা এগিয়ে আসেন। কিন্তু না, তাঁদের ফেরার সংবাদ পেয়েও কোনও স্বজনই তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন না। তাঁদের আপন করতে এগিয়ে এলেন না। আর এক প্রস্থ অভিমান হল। সেই অভিমান নিয়েই ওঁরা পাড়ি দিলেন লখনৌর পথে।
প্রথমে উঠলেন মমতাজ হোসেনের বাড়িতে। তারপর রাজা শ্রীপাল সিংহের বাড়ি ভাড়া নিয়ে সংসার পাতলেন। মমতাজ তাঁকে লখনৌর গণ্যমান্যদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। আদালতের কাজের জন্য চোস্ত উর্দু জানা প্রয়োজন। তাই মমতাজই ব্রিজরাজ কিশোর নামের এক চমৎকার উর্দু শিক্ষক ঠিক করে দিলেন। তাঁর শিক্ষায় অল্পকালেই অতুল নিজেকে তৈরি করে ফেললেন।
১৯০২ থেকে ১৯০৫--এই তিন বছরের মধ্যেই অতুল লখনৌর বুকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেন। তারই সঙ্গে দানে-ধ্যানে রাজনৈতিক-সামাজিক বহুধা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে সকলের সম্ভ্রমের মানুষ হয়ে উঠলেন, হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় 'সেন সাহেব'।
অতুল-হেমকুসুম এতদিনে যেন সুখের মুখ দেখলেন। দু'জনে স্বপ্ন বুনতে লাগলেন শহরের বুকে নিজেদের একখানা বড় বাড়ি হবে, তাতে থাকবে দারুণ একখানা গোলাপের বাগান। গোলাপে কাঁটা আছে বটে। তা থাক। তবুও তা যে দু'জনেরই বড় প্রিয়!
ইতোমধ্যে দুর্গামোহন মারা গেছেন। অতুলের তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মা এই সময় উদ্যোগী হয়ে ছেলের অভিমান ভাঙিয়ে ছেলের কাছে থাকতে চলে এলেন।
'প্রতিষ্ঠা' অতুলের ক্ষতে ঔষধ হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হবার পর তিনি ভুলতে পেরেছিলেন আত্মীয়-স্বজনদের অন্যায় ও দুর্ব্যবহার। তিনি তাঁদের ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু, হেমকুসুম কাউকেই ক্ষমা করতে পারেননি। তিনি ভুলতে পারেননি অভাবের সংসারে বিনা চিকিৎসায় সন্তানের মৃত্যু। তাঁর বারে বারেই মনে হয়েছে যে, এর মূলে রয়েছে তাঁদের বিয়েতে আত্মীয়-স্বজনের বিরোধীতা, স্বার্থপরতা, উদাসীনতা। ফলে, এই নিয়ে অতুলের সঙ্গে তাঁর অশান্তির অবস্থান তৈরি হল। অতুলের মাকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না।
অশান্তি সংসারে আগুন জ্বালাল। অতুল মাকে ত্যাগ করতে পারলেন না। ভাবলেন, সবাইকে মিলিয়ে সব কিছু সেই আগের মতো করে নেবেন। না, বাস্তবের সঙ্গে ভাবনা মিলল না। হেমকুসুম মানুষ হিসেবে অসম্ভব জেদী। তাঁর মনে হল, ক্ষমা যদি করতেই হয় কাউকে, নিজের বাবাকে করবেন। অন্য কাউকে না। কিছুতেই না।
ফলে, তিনি পুত্রের হাত ধরে বাপের বাড়িতে হাজির হলেন। না, হেমকুসুম সংসার ত্যাগ করলেন না। তবে, হেমন্তশশী মারা না-যাওয়া পর্যন্ত এই জেদ-অভিমানের পালা শেষ হল না। সে-এক ব্যথার কাল, গানে গানে স্বাক্ষরিত হয়ে আছে সে-কালের কথা:
'তব অন্তর এত মন্থর আগে তো তা জানি নি।
ভেবেছিনু ফুটিবে ফুল শুনি পিক রাগিনী।
মধুরাতে ফুলহাতে গান কি মোর শোননি।
কেন রাকা মেঘে ঢাকা ওগো অভিমানিনী।
তুমি যারে ভুলিবারে চাহিয়াও চাহনি
সে তোমারে বারে বারে চাহে দিনযামিনী,
ধরা শেষে দিবে এসে তারে অনুরাগিনী।
তবে কেন ধাও হেন ওগো বন হরিণী।'
এ-বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী ছিল। দু'জনেই তো গোলাপ ভালোবাসতেন। গোলাপে সুবাস আছে কাঁটাও আছে। বিচ্ছেদ-মিলন দুই মিলিয়েই যেমন জীবনের পূর্ণতা, তেমনি স্রষ্টার সৃষ্টিরও পূর্ণতা। তাঁদের সেই পূর্ণ মিলনের গানও রচিত হয়েছে, তাঁর সৃজনে:
'আজ আমার শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর
ওগো অনেক দিনের পর
আজ আমার সোনার বধূ এল আপন ঘর
ওগো অনেক দিনের পর।'
আর এই সুন্দরময় পূর্ণতা নিয়েই অতুলপ্রসাদ রয়েছেন আজও বাংলা গানের প্রবল ধারায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে, আন্তরিক হয়ে রয়েছেন আমাদের প্রাণে...