সূর্যের মন পড়ার জন্য আন্দিজ পর্বতে আরোহন করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী এবং দীপঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের বায়ুমণ্ডল করোনার অভ্যন্তরের নানাদিক তুলে ধরে ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। সাধারণ সময়ে সূর্যের প্রখর তেজের কারণে করোনা সঠিকভাবে প্রতক্ষ্য করা যায় না। এটি একমাত্র সম্ভব হয় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়। যেই সময় চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী এক সরলরেখায় অবস্থান করে সেই সময়েই একমাত্র করোনা দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে।এর আগেই বিজ্ঞানীরা গ্রহণের সময় সূর্যের অবস্থান সংক্রান্ত দুটি মডেল প্রস্তুত করেছিলেন। সেই মডেলের সাথে তাদের গবেষণার ফলে প্রাপ্ত ডেটা মিলে যায় কিনা সেটাই ছিল দেখার বিষয়। আন্দিজের শিখরে উঠে গবেষণার ফলে প্রাপ্ত ডেটা তাদের দুটি মডেলের সাথেই মিলে গেছে বলেই জানা গেছে।
মহাকাশবিজ্ঞানীদের মতে, সূর্যের এইসব অভ্যন্তরীণ হাবভাব আগে থেকে বিজ্ঞানীদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে এবার থেকে অনেক সহজেই নানা মহাকাশ সংক্রান্ত তথ্য হাতে চলে আসবে। এর ফলে আগামী ১২ বছরের মধ্যে সৌর ঝড় থেকে শুরু করে সৌর হামলা কখন, কোথায় হতে চলেছে তা অনেক আগে থেকে জেনে সতর্ক থাকা যাবে।উপগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ সংরক্ষণেও এই গবেষণা যথেষ্ট সাহায্য করবে বলেই জানা গাছে।প্রফেসর দিব্যেন্দু নন্দীর যে দুটি মডেল তার গবেষণা স্যা টি মিলে গেছে সেগুলি হলো, ১) সোলার সারফেস ফ্লাক্স ট্রান্সপোর্ট মডেল এবং ২) পোটেনশিয়াল ফিল্ড সোর্স সারফেস মডেল। এর মধ্যে প্রথম মডেলটি সূর্যের পিঠ থেকে কিভাবে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরী হয় তার পূর্বাভাস দিতে পারে। অপরদিকে, এই চৌম্বকক্ষেত্র কিভাবে উপরের দিকে উঠে করোনাকে উত্তপ্ত করতে পারে তার পূর্বাভাস দিতে পারে দ্বিতীয় মডেলটি। মডেল দুটি তৈরী পর থেকেই এই মডেল দুটি পরীক্ষা করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন অধ্যাপক দিব্যেন্দুবাবু। তাকে এই মডেল বানাতে সাহায্য করেছেন কলকাতার তিন গবেষক ছাত্রছাত্রী প্রান্তিকা ভৌমিক, সৌম্যরঞ্জন দাশ এবং আথিরা বি এস।
তারা জানান, সূর্যের মনের জট এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে খোলা সম্ভব হয়নি। এই গবেষণার ফলে মাসখানেক আগে থেকে সৌরঝড়ের আভাস দেওয়া যাবে এবার থেকে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জানিয়েছেন, সৌরঝড়ের অভ্যাস আগে থেকে পাওয়া গেলেও সূর্যের পিঠের দিকে অবস্থান করা চিপযুবক ক্ষেত্রগুলির জন্যই কি সৌরপিঠের কাছে পৌঁছে সূর্যের অন্দরের প্রখর তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যায় কেন? এই নিয়ে গবেষণা করা বাকি ছিল। এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ সেই সুযোগও এনে দিলো বিজ্ঞানীদের সম্মুখে।দীপঙ্করবাবু জানালেন এর কারণ। তিনি জানান, সূর্যের অভ্যন্তরে তৈরী হওয়া চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি সূর্যের পিঠ বা তার কিছুটা নিচ থেকে তৈরী হয়ে উপর দিকে অর্থাৎ করোনার দিকে যাত্রা করে। এরাই করোনাকে উত্তপ্ত করে তোলে।
দীপঙ্করবাবু জানান, এই চৌম্বকক্ষের কখনো কখনো উপর দিকে উঠে আবার নিচে দিকে নেমে আসে। এইগুলিকে বলা হয় 'ক্লোজড লুপ'। এই লুপের ফলেই সৌরঝড় করোনারি মাস ইজেকশন প্রভৃতি ঘটনা ঘটে থাকে। কিছু কিছু শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র আবার উপরে উঠতে উঠতে করোনাকে ছাড়িয়ে সৌরমণ্ডলের শেষপ্রান্তে চলে যায়।এদের বলা হয় 'ওপেন লুপ'।সৌরমণ্ডল পেরিয়ে যাওয়া এই চৌম্বক ক্ষেত্রকে সৌরবায়ু বলা হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই বায়ু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এলে তা যথেষ্ট ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আগে থেকে সূর্যের অভ্যন্তরের এই সব গোপন খবর যদি জেনে যাওয়া যায় তাহলে পৃথিবীকে হঠাৎ ধেয়ে আসা সৌর বায়ু বা সৌর ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। আগে থেকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও গড়ে তোলা যাবে এই দুর্যোগের বিরুদ্ধে। তাই আন্দিজ অভিযান নিয়ে বেশ আশাবাদী মহাকাশবিজ্ঞানীমহল।