ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী অসম
ষাট এর ফলক ছুঁতে চলল অসমের ভাষা আন্দোলন।
প্রকৃতি তাঁর সুন্দরের ভাড়ার উজার করে ঢেলেছে অসম রাজ্যের এই উপত্যকায়। আকাশে বাতাসে ঘোরাফেরা করে শান্তি। সেই আকাশেও ঘনিয়েছিল অশান্তির ঘন ঘটা।ভাষার অধিকার ঘিরে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা রাজ্য অসম।বিভক্ত দুটি উপত্যকায়। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক । বরাকে রয়েছে তিনটি জেলা - কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি।
বর্তমানে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ সেখানে ভাষা ও জাতে বাঙালি।
১৯৬১’র ১৬ মে। অসম রাজ্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবীতে প্রাণ দেন এগারো জন।সেই আহুতি থেকেই উঠে আসে রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি। প্রাণের দোহায় আবারও ভাষার জয়জয় কার।
অসম রাজ্যের একটা অংশে বাংলার সংখ্যা গরিষ্ঠতা। এটাই মেনে নিতে পারেননি স্থানীয় নেতারা। সেখান থেকেই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সুচনা।ভাষা কে কেন্দ্র করে।
সরকারের অধিপতি তখন অসমিয়রাই। বাঙালিদের উপর চলতে থাকে নানান উৎপীড়ন। বহুদিনের কর্ষিত জমি, সেচ চলে যেতে থাকে অসমিয়দের মালিকানায়। এখানেই বীজ বপন ক্ষোভের।
এরপরেই আসে সেই কালো দিন। বিধানসভায় পাশ হয় বিল। সর্বোচ্চ ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয় অসমিয়া কে। বাঙালি সহ সকলকেই চলতে গেলে জানতে হবে অসমিয়া।
শুরু হয় বাঙালির প্রতিবাদের গর্জন। রাজপথে তখন ভালো ভাষার মিছিল। আন্দোলনে দাবী ওঠে, জান দেব তবু ভাষা দেব না। চাই বাংলা ভাষার স্বীকৃতি, রাজ্যস্তরে সরকারি ভাষা হিসেবে।
উপত্যকা জুড়ে চলে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন। সংগ্রামের আগুন হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও কাছাড়ে। স্কুল-কলেজে সরকারি নির্দেশ পৌঁছে গেল, কেউ যদি ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয় তবে তৈরি থাকতে ভয়ঙ্কর শাস্তির জন্যে।
শুরু হল সত্যাগ্রহ। ১৬ তারিখ আন্দোলনে শরিক হতে শিলচর স্টেশনে জমায়েত হাজার হাজার মানুষ। চলছিল অবস্থান ধর্মঘট। মুখে মুখে ভাষার জন্য স্লোগান।
কথা ছিল বিকালের মধ্যে আন্দোলন শেষ হবে। সেখানেই বিনা মেঘে বজ্রপাত। বাইরের আলোয় তখন দুপুর সবে গা এলিয়েছে।
শুরু হয় আধাসামরিক বাহিনীর অতর্কিতে গুলি ।লুটিয়ে পড়েন তরুন তাজা বছর পঁচিশের ১১ তরুণ-তরুণী।সকলেই পঁচিশ ছুঁই ছুঁই। দু’জন আঠারোর সূর্য না দেখা কিশোর।
চল্লিশ হাজার মানুষের শোকমিছিল পথে নামে । ১১ শহীদের শেষকৃত্য হয় শিলচর শ্মশানে। আজও সেই শ্মশানে এই ১১ শহীদের ১১টি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে। প্রতিটি স্মৃতিস্তম্ভের সামনে নামফলক রয়েছে শহীদদের।
শুধু তা-ই নয়, শিলচর স্টেশনের সামনে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল এই ১১ তরুণ-তরুণীকে, সেখানেও তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। ১১ শহীদের নামে ১১টি স্তম্ভ।
অসমের গান্ধীবাগ। সুদৃশ্য শিশুপার্ক। পার্কের পিছনের দিকে রয়েছে ঐতিহাসিক এই ভাষা আন্দোলনের স্মরণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধ। মিনার গড়া হয়েছে মন্দিরের আদলে।
ভিতরে মেঝের ওপর ১১টি কৌটায় রাখা ১১ শহীদের চিতাভস্ম। মাঝে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা একটা বড় পদ্মফুল।
অসমিয় বাঙালিদের এই ভাষা বলিদান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাকাশে হয়েছে ইতিহাসের পাতায়।২১ শে ফেব্রুয়ারির জাঁকে ১৬ই মে-র শহীদরা কি তবে অস্তাচলের বাসিন্দা!