সম্প্রতি অসমের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রতিবছরই বন্যা এখানে বিধ্বংসী আকার নেয়। গত বছর কেরলের বন্যা প্রাণ নিয়েছিল অনেকের। প্রকৃতির সেই রূপ ফিরে এসেছে আবারও।
অসম স্টেট ডিজাস্টার অথোরিটির তথ্যানুযায়ী, ১.৫ লক্ষ হেক্টরের অধিক জমি রয়েছে জলের তলায়। এর ফলে পশুপালন ও কৃষিকার্যের মতো মানবজীবনের দু’টি প্রধান জীবিকা কার্যত ব্যহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কেন্দ্রীয় সরকার যখন জাতীয় বিপর্যয় প্রতিক্রিয়া বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থাগুলিকে ত্রাণকার্যে নিযুক্ত করছে, তখন একাই বন্যাবিধ্বস্ত মানুষদের সাহায্যার্থে অভিনব উপায়ে একটি ‘মিউজিক ভিডিও’ বানিয়ে সচেতনতার বার্তা দিচ্ছেন অসমের সঙ্গীতশিল্পী রাহুল রাজখোওয়া। গানটি নিজেই লিখেছেন তিনি। রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলিতে ত্রাণ পৌঁছে দিতে দেশের সমস্ত অ-লাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির কাছে আবেদনও জানিয়েছেন তিনি।
মূলত, ত্রাণ তহবিলে দান এবং সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সেই ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার মাঝে সেতুবন্ধনের কাজ করছেন রাহুল। এই মধ্যস্থতার মধ্যে দিয়েই রাহুল মনে করছেন, চাইলেই বিপদে এগিয়ে আসা যায়, শুধু যোগাযোগের সেতুবন্ধনটি সঠিক সময়ে তৈরী করতে হবে।
২০১৭-তে তিনি অসমের গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলি পরিদর্শনে যান। সে সময় সেখানকার সন্ত্রস্ত মানুষদের দুর্দশার ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে রাখেন। এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন জনসাধারণ’কে সচেতন করতে তা থেকে একটি গান রেকর্ড করে মিউজিক ভিডিও’র মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
“ভিডিওটির খোঁজ পেয়ে অক্সফাম (একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা) এগিয়ে আসে এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে গৌহাটিতে আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানায়। শুধু তাই নয়, অজস্র স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে তাঁরা এগিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানায়। যাঁরা আমার ভিডিও শেয়ার করেছেন ও বন্যা তহবিলে দান করতে চেয়েছেন, তাঁরা আমারর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।“ বলছেন ৩৪ বছরের রাহুল।
কেউ কেউ যেমন ত্রাণ তহবিলে অর্থসাহায্য করছেন, তেমন বন্যা বিধ্বস্তদের কাছে মৌলিক ও প্রাথমিক সুবিধাগুলি পৌঁছে দেওয়ার কাজও করছেন অনেকে।
বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলির মধ্যে পানীয় জল অন্যতম প্রধান বিষয়। আর এই পানীয় জল সমস্যার দৃষ্টান্ত তৈরী করেছে বন্যা কবলিত এলাকাগুলি।
“প্রত্যেক পরিবার দিনে মাত্র ৪ পাউচ/প্যাকেট করে জল পাচ্ছেন। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন নির্বাহ করার ক্ষেত্রে যা খুবই সামান্য।“ বলছেন রাহুল।
‘বিসলারি’, ‘অ্যাকোয়াফিনা’র মতো পানীয় জলের সংস্থাগুলির এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিৎ বলে মনে করছেন তিনি।
আরেকটি প্রধান সমস্যার বিষয় স্বাস্থ্য। অধিকাংশ জলই অপরিষ্কার ও দূষিত হওয়ার ফলে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অনেক মানুষ ত্রাণে সাবান পাঠিয়েছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত স্নানের জল না থাকার ফলে সেগুলি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সাবান ব্যবহারে জলের অপচয় বেশী হবে, এই আতঙ্কে সাবান ব্যবহার করছেন না গ্রামবাসীরা। উপায় না থাকায় দূষিত জল ব্যবহার করছেন অনেকে। এমতাবস্থায়, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও অন্যান্য হাইজিনমূলক দ্রব্যের সাহায্যে দূষিত জলের ব্যবহার কমিয়ে আনা যেতে পারে।
“লাইফ বয়, ডেটলের মতো ব্র্যান্ডগুলি এ বিষয়ে এগিয়ে আসলে অনেকটাই উপকৃত হবেন বন্যা-বিধ্বস্ত মানুষেরা। ফলে পুরো ব্যাপারটাই আরও সুসংবদ্ধ হবে,“ এমনটাই মনে করছেন রাহুল।
রাহুল রাজখোওয়া'র সেই গান-
অন্যদিকে, বাসস্থান ও আশ্রয়স্থল নিয়েও সমস্যা দেখা গিয়েছে। বহু মানুষ ঘর ছেড়েছেন আশ্রয়ের আশায়। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া গেলেও অনেকেই তাঁদের ভিটে ছেড়ে যেতে নারাজ। প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে বেশীরভাগ তাঁবু অব্যবহার্য হয়ে পড়েছে, ফলে ব্যহত হয়েছে জনজীবন। এ অবস্থায়, সঠিক জায়গায় তাঁবু নির্মাণ করে, তাঁদের সুরক্ষিত অঞ্চলে স্থানান্তরিত করে তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, বন্যার ফলে মানুষের পাশাপাশি বিপর্যস্ত হয়েছে বন্যপ্রাণ। কাজিরাঙা অভয়ারণ্যের ৯০ ভাগ জলের তলায় থাকার দরুণ বহু বন্যপ্রানী বাসস্থানচ্যূত হয়ে পড়েছে। বন্যার কারণে ২০১৬ থেকে ২৮টিরও বেশী গন্ডারের মৃত্যু হয়েছে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, এ বছর ৩০টিরও বেশী একশৃঙ্গ গণ্ডার হারিয়ে গিয়েছে। ফলে বিপদে প্রহর কাটাচ্ছে গন্ডার শাবকেরা। অনেকেই মাতৃহারা হয়ে যাওয়ায় পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছে না। এ অবস্থায়, দিনে অন্ততপক্ষে ৬ প্যাকেট করে ল্যাক্টোজেন প্রয়োজন তাদের।
শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, রাজ্যের ৩৩টি জেলার মধ্যে ৩০টি জেলাই রয়েছে জলের তলায়। মৃতের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বিপদসীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে জল। ৪,১৫৭টি গ্রামের ৪২ লক্ষ মানুষ জনজীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে কার্যত দুরাবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করছেন।
পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ার আশায় দিন গুনছেন বন্যপ্রাণী সহ গ্রামবাসী তথা দেশবাসীরা।