আসামের কাজিরাঙ্গার বোচাগাঁও গ্রামের ঘটনা। রাত্রি প্রায় শেষের দিকে। সারাদিন হাল ভাঙা খাটুনির পর সকলে যে যার ঘরে তন্দ্রামগ্ন। হঠাৎই কিছু মুরগির অস্বাভাবিক ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় পাড়া প্রতিবেশীর। প্রাপ্তবয়স্করা হন্তদন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই নজরে আসে একটি বৃহৎ আকারের সাপ যেটা কিনা একটি মুরগিকে প্রায় গিলে ফেলেছে। সকলেই আতঙ্কিত। ফানুস আর লাঠি তাদের হাতেই ছিল। যদিও ততক্ষণে তারা একটি নিরাপদ দূরত্বে সাপটিকে ঘিরে ফেলেছে। অন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীরা সাপটিকে হত্যা করতে পারতো। কিন্তু তার পরিবর্তে তাঁরা ডাক দিলেন সেই মানুষটাকে যিনি কথা বলতে পারেন প্রকৃতির সঙ্গে।
"আজ থেকে দশ বছর আগে হলে এখানে অন্য কিছু ঘটতে পারতো। গ্রামবাসীরা দু-বার ভাবতো না, সাপটাকে মেরে ফেলতে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। এলাকার মানুষদের মনোভাব বদলে গিয়েছে। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান সম্পর্কে গ্রামবাসীরা এখন যথেষ্ট গুরুত্ব দেন এবং এই বিষয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা রয়েছে। এখন একটা সাপকে তাঁরা সম্মানের চোখে দেখে।"
-দুই সন্তানের বাবা, ৪৪ বছর বয়সী মনোজ গগৈ একটানা বলে চলেন কথা গুলো।
গ্রামবাসীদের মানসিকতা পরিবর্তনের পিছনে তাঁর যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, একথা নিজের মুখে স্বীকার করতে লজ্জিত বোধ করছিলেন তিনি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, এটা শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেই ঘটেনি। গ্রামের ছোটোদের মধ্যেও এই সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতিকে আরো ভালোভাবে বোঝবার একটা তাগিদ তাঁদের মধ্যে লক্ষ্য করা গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে এই বোধটা কাজ করেছে যে, বন্যপ্রাণীদের সত্যিই সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে।
কাজিরাঙ্গার ফাউন্ডেশন কার্যালয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর ডাক্তার নবীন পান্ডে জানাচ্ছেন, "মনোজের এমনই প্রভাব, একদিন একটা ছেলেকে করবেট ফাউন্ডেশন অফিসে ছুটে আসতে দেখলাম। তার হাতে একটা কচ্ছপ ছিল। আমাদের জানালো যে তার বাড়ির লোকেরা কচ্ছপটিকে পোষা প্রাণী হিসেবে ঘরে রাখতে চায়। ছেলেটি তার বাবা-মা'কে অনুরোধ করে যাতে কচ্ছপটিকে আবার প্রকৃতির কোলে ফিরিয়ে দেওয়া যায়.. সেই সূত্রেই সে কচ্ছপটিকে চুরি করে আমাদের কাছে নিয়ে আসে। তিনি চাইছিলেন আমরা কচ্ছপটিকে কোনও প্রাকৃতিক সুরক্ষিত অঞ্চলে মুক্ত করে দিই।"
এই স্বতন্ত্র প্রকৃতিবিদের তাৎপর্যপূর্ণ যাত্রা ও অভিজ্ঞতাগুলো তাকে বহু জায়গা থেকে একাধিকবার প্রশংসনীয় করে তুলেছে। ২০১৪ সালে ‘কার্বেট ফাউন্ডেশন’ ইতিমধ্যেই তাঁকে 'ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ারিয়র' পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছে। এছাড়াও বিগত বছরে অসমিয়া পরিচালক ধৃতিমান কাকাতি পরিচালিত 'দ্য ম্যান হু স্পিকস নেচার' নামক একটি তথ্যচিত্রের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন মনোজ।
কী এমন ঘটেছিল যা মনোজকে উৎসাহিত করেছিল এবং প্রবলভাবে প্রকৃতির দিকে ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের দিকে টেনে নিয়েছিল?
"আসামে কাজিরাঙ্গা এলাকাতেই আমার জন্ম। এখানে আমি গন্ডার, চিতাবাঘ, হিমালয়ের সুন্দর পাখি, সাপেদের সাথে মিশে প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠেছি। শৈশব থেকেই এটা আমার কাছে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ। স্বাভাবিকভাবেই আমি প্রকৃতির সাথে একটি সত্যিকারের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছি।"-মনোজ গগৈ।
বড় হওয়ার সাথে সাথে মনোজ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি ঠিক কি করতে চান। এবং এর জন্য যা কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ের 'বোম্বাই ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি'তে একমাসের কোর্স সম্পূর্ণ করেন।
শিক্ষাগত যাত্রা, সেই সঙ্গে তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ভাবনা এবং আবেগকে একটা গঠনমূলক রূপ দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মনোজ। তাঁর পরিবার প্রথম দিকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। তাঁর বাবা, যিনি রাষ্ট্র বিদ্যুৎ বোর্ডের একটি লাইনম্যান ছিলেন, সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও তা প্রত্যাখ্যান করে মনোজ একটি অপ্রচলিত কর্মজীবনের পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
"আমার বাবা প্রথমে এই বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন। কেউ হয়তো তাকে বলেছিল যে বন্যপ্রাণী ধরা অবৈধ। এতে আমার জেল পর্যন্ত হতে পারে।"
মনোজ দীর্ঘদিন ধরে একা পাখি, সরীসৃপ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সংরক্ষণ এবং পুনর্বাসনের কাজ করছিলেন। তবে মাঝে মাঝে লোকেরা তাঁকে মাঝরাতের দিকে ফোন করতো। মনোজ তখন থেকেই তাঁর মতো উৎসাহীদের একটা দল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৭'এ ১১জন সমমনস্ক মানুষদের নিয়ে মনোজ তাঁর সংগঠন ‘এনআরএসবি’ [the Naturalists for Rehabilitation of Snakes and Birds (NRSB)] শুরু করেন। বর্তমানে এই সংস্থাটির ১০০ জন সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবক কর্মরত।
এনআরএসবি'তে অবদান রাখতে মনোজ আসামের রাজ্য পর্যটন দপ্তরের সঙ্গে চালক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। মুম্বাইয়ের সেই এক মাসের কোর্স ২০১৩ সালে একটি বেসরকারি রিসর্টে পর্যটকদের গাইড হিসেবে সুরক্ষিত কাজ করতে তাঁকে সাহায্য করেছিলো। একটা দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ১৫০০ টাকার সামান্য বেতনে কাজ করছিলেন এবং কখনো কখনো পর্যটকদের বকশিস ছিল উপরি পাওনা।
"বিদেশী পর্যটকেরা আমাকে সবসময়ই একটা ভালো বকশিস দিত। মরসুমের একদম শীর্ষে বেশিরভাগ মাসেই আমার আয় ৬০,০০০-৭০,০০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। আর এই বেতনের সিংহভাগ আমি বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করতাম।"
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এনআরএসবি'র নাম খুব দ্রুতই বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সবথেকে বৃহৎ ও বিষাক্ত সাপগুলোকে উদ্ধার করার জন্য তাঁদের ডাক পড়তে থাকে৷ এটা বন্যপ্রাণীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে একদম ইতিবাচক একটা দিক ছিল, যখন মানুষেরা হত্যার পরিবর্তে উদ্ধারকার্যে মনোনিবেশ করা শুরু করেছে।
"ঘটনাগুলো ঘটলেই লোক জড়ো হয়ে যায়। আমি বন্যপ্রাণীদের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য সেই সুযোগুলোকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করি। আমি তাদেরকে বোঝাই যে তাদের হত্যা করা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সেই সম্পর্কে কথা বলি। অবশ্যই, সেই সচেতনতা একদিনে তৈরি হয়নি। কিন্তু এখন ১০ বছর পর আমি তাদের মনোভাবের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এখন তারা সাপগুলোকে মেরে ফেলার পরিবর্তে আমাকে ডাকে।"
বদল এসেছে খুব ধীরে ধীরে। ২০১৩ তে যখন মনোজের কাজের পরিচয় সকলের অগোচরে এসে পড়ে, করবেট ফাউন্ডেশন তাকে একটা কাজের প্রস্তাব দেয়। ফাউন্ডেশন তাকে তার সমস্ত রকম বন্যপ্রাণী উদ্ধারকার্যের ব্যয় বহন করার আশ্বাসও দিয়েছিল। আর তারপর থেকেই মনোজ কাজিরাঙ্গার একটি অফিসে উদ্ধার দপ্তরে নিজের কাজ শুরু করেন। মনোজ অত্যন্ত আনন্দের সাথে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জানতেন যে এটা শুধুমাত্র তাকে তার পরিবারের ব্যায় ভার বহন করতেই সাহায্য করবে না, এতে উদ্ধারকার্যের পরিধিও প্রশস্ত হবে।
ডাক্তার পান্ডের মতে, "তাঁর সবরকম কার্যকলাপ অফিসে খুব ভালোভাবেই নথিবদ্ধ অবস্থায় আছে। এখানে দিন বা রাতের ঠিক কোন সময়ে বন্যপ্রাণীটিকে উদ্ধার করার জন্য তাকে ডাকা হয়েছিল, সেখান থেকে সাইটটা কতদূর এইসব বিবেচনা করে আমরা সবকিছু নথিবদ্ধ করি। মনোজ কিন্তু কোনোদিন কখনো কোনো নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেননি। সে যেখানেই থাক না কেন, এমনকি সেটা যদি তিনি ৬০ কিলোমিটার দূরে থাকেন, তাও।"
"এখনও পর্যন্ত এটা একটা অসাধারণ সুদীর্ঘ যাত্রা। এবং আমি আশা করি একটা দীর্ঘ সময় ধরে এটা অব্যাহত থাকবে। ২০০৭ থেকে সে তার উদ্ধারকাজ গুলোকে একসাথে নথিবদ্ধ করতে শুরু করে। যার ফলাফল, ইতিমধ্যেই উদ্ধার হওয়া বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৫,০০০ ছাড়িয়েছে।"
২০০৫ ও ২০০৬ সালে মনোজ যেসব পাখি আর সাপেদের উদ্ধার করেছে, এই নথিতে সেগুলোকে তালিকায় রাখা হয়নি।
ফাউন্ডেশনের আয়োজিত সংরক্ষণ শিক্ষা কর্মসূচির সাথেও মনোজ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। এই ধরনের কর্মসূচীগুলোর মাধ্যমে তিনি এমনভাবে উদ্ধারকার্যের গল্পগুলো সামনে নিয়ে আসছেন, যা শিশুদের প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে।
তবে মনোজের কাছে এখনো পর্যন্ত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয় স্মৃতি, যখন মনোজ মাছরাঙা পাখির তিনটি ছোট ছানাকে উদ্ধার করেন, যখন ওদের চোখও ফোটেনি।
"যতদিন না ওরা উড়তে পারছে আমি ওদেরকে আমার কাছে রেখে খেয়াল রাখছিলাম।"-গর্বের সঙ্গে বলেন মনোজ।
"আমি আমার জীবনের বেশীটাই শিখেছি অভিজ্ঞতা থেকে। শিখেছি প্রতিটি প্রাণীই একে অন্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ। এখনও অবধি আমি গন্ডার শাবক, চিতাবাঘ, হরিণ, বন্য শূকর, জংলি বেড়াল, মেছো বেড়াল ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উদ্ধার করেছি। আমি ১৪ ফুট দীর্ঘ একটা কোবরাকেও উদ্ধার করেছি যেখানে আমার জীবনহানি হতে পারতো।"- আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন এই প্রকৃতিপ্রেমী।