‘উপন্যাস আমাকে অনেকটা প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে তবু ছোটগল্পের ওপরেই আমার পক্ষপাত’ - বলেছেন আশাপূর্ণা দেবী। আশাপূর্ণার সর্বাধিক খ্যাতি তাঁর ট্রিলজি ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি', 'সুবর্ণলতা’ আর ‘বকুলকথা’ কে ঘিরে। সন্দেহ নেই, এই ত্রয়ী উপন্যাস বাংলাদেশের এক সময়কালের দলিল, অন্তঃপুরের খুঁটিনাটির অসামান্য ইতিবৃত্ত, নারীর লাঞ্ছনা,অবমাননা আর প্রতিবাদের অনবদ্য নিদর্শন। কিন্তু এর বাইরে আশাপূর্ণার ছোটগল্পসম্ভারে যে কত রত্ন, কত মণিমাণিক্য তার সংবাদ ক’জন রাখে?
আশাপূর্ণা দেবীর জন্ম ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জানুয়ারি মধ্য কলকাতার পটলডাঙার মামাবাড়িতে। বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও মা সরলাসুন্দরী দেবীর পঞ্চম সন্তান (তৃতীয়া কন্যা) আশাপূর্ণার নাম রেখেছিলেন তাঁর প্রাচীনপন্থী কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্না ঠাকুরমা। যার প্রবল আপত্তিতে আশাপূর্ণাদের তিন বোনের স্কুলেই যাওয়া হয়নি। দাদাদের পড়া শুনে আর উল্টোদিকে বসে তাদের লেখা দেখে আশাপূর্ণা লিখতে শিখেছিলেন উল্টো হরফে। মা সরলাসুন্দরীর ছিল বই পড়ার নেশা। বাড়িতে আসত তখনকার দিনের প্রকাশিত গল্প উপন্যাস ও নানান পত্রপত্রিকা।সেখানেই দীক্ষা সাহিত্যে।
মাত্র তেরো বছর বয়সে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় ছাপা হল তাঁর প্রথম কবিতা ‘বাইরের ডাক’। একবছরের মধ্যে ‘খোকাখুকু’ মাসিক পত্রিকার কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেল আশাপূর্ণার ‘স্নেহ’ কবিতা। আরও একবছর পরে বাংলা ৬ই শ্রাবণ ১৩৩১ তাঁর বিবাহ হল ব্যাঙ্ক কর্মচারী গোয়ারি কৃষ্ণনগরের আশুতোষ গুপ্তর সঙ্গে। ফুরিয়ে গেল ছেলেবেলা। যে ছেলেবেলা সম্পর্কে অনেক পরে আশাপূর্ণা বলেছিলেন, ’হিসেব মতে আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে সংসার ঊর্দ্ধে একটি স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ।
‘যদিও আশাপূর্ণা ঘুড়ি ওড়াতেন, দাদাদের সঙ্গে মার্বেল খেলতেন, ক্যারাম খেলতেন আর তাঁরা তিন বোনে মিলে ছিলেন যেন 'এক মলাটে তিনখানি গ্রন্থ’। সাহসিনী তো ছিলেনই। দিদি রত্নমালার বিয়ের পর দুই বোন আশাপূর্ণা আর সম্পূর্ণা চিঠি পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে।
তাতে ছিল একটি চাওয়া - ‘নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে একটি উত্তর দেবেন।‘ এসেছিল উত্তর ‘আশাপূর্ণা তুমি সম্পূর্ণা’ - রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে লেখা সে চিঠি পেয়ে উচ্ছ্বসিত দুই কিশোরীর আনন্দের অবধি ছিল না। ‘একটু স্থির হতেই ছুটে গেলাম মা-র কাছে।...মা একটুক্ষণ সেই হাতের লেখার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন,’তোরা পারলি? আমি শুধু স্বপ্ন ই দেখেছি’। স্বপ্ন দেখা মায়ের স্বপ্ন সার্থক করা মেয়ে আশাপূর্ণা।
“স্যাঁতস্যাঁতে বাংলাদেশের বিদ্রোহিণী নারী' বলে আশাপূর্ণাকে আখ্যাত করেছিলেন বনফুল - বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বিদ্রোহিণীই বটে! ছোট গল্পগুলিতে আশ্চর্য সব নারী-পুরুষের ছবি এঁকেছেন আশাপূর্ণা। 'নীলরক্ত' গল্পের ছোট করে কাটা চুল, উদ্ধত ভঙ্গী, দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে সরমা তাদের একজন। বাবার মদের পয়সার জোগান দিতে যাকে অন্য ফ্ল্যাটে ঢুকে টাকা চুরি করতে হয়। ”পয়সা না পেলে ঠেঙিয়ে হার গুঁড়ো করে দেয় বাবা”।
এই মেয়েটির কথা যে তুলে ধরে, সেই কথক পুরুষটির চরিত্র কি নির্মোহ ভাবে তুলে ধরেন আশাপূর্ণা। কিছুক্ষণ আগে তার মমতা উথলে উঠেছিল, মুহূর্তের মধ্যে … ‘ভালো ভালো কথার মোহ ত্যাগ করিয়া প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করিয়া দিতে বৌদির পিছন পিছন বাহির হইয়া আসিলাম। নিতান্ত তাচ্ছিল্যভরে বলি – তুমি কি ক্ষেপে গেলে বৌদি? ওটাকে আমি’...। ‘মৃত্তিকা’ গল্পের পুরুষ চরিত্র কাঞ্চন। হতদরিদ্র অথচ উচ্চশিক্ষিত এই যুবকের জীবন আকস্মিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তার বিবাহ হয় ধনী পরিবারের গর্ভবতী মনুর সঙ্গে। অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনে কাঞ্চন যত না পুলকিত তার চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তি বোধ করে।
বিশাল বাড়ি, নিজস্ব লাইব্রেরি তাকে যতটা বিস্মিত করে ততটা আনন্দিত করে না। তার পূর্বের দারিদ্র্যই যেন তাঁর কাছে কাম্য হয়ে ওঠে। অথচ স্ত্রীকে সে যে ভালবাসে না তা নয়। কিন্তু যে সন্তানের কথা সে মনে করতেই চাইত না, সেই সন্তানের মুখ যেন তার সমস্ত যুক্তির বাঁধ ভেঙে দিল। অর্থ মোহে অন্যের সন্তানের পিতৃত্ব সে মেনে নিতে পারল না।
‘অসতর্ক’ গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র শুভ্রা যত জটিল, তার চেয়ে কম জটিল নয় সরোজকান্তি ও নিরুপম। ‘অপরাধ, ’অর্থহীন’, ’কসাই’, ইত্যাদি গল্পের নারী চরিত্রের পাশাপাশি পুরুষ চরিত্রগুলোও সমান উজ্জ্বল। সে পুরুষ কখনও 'কসাই’ গল্পের মধ্যবিত্ত বাঙালি সমরেশ, কখনও বা সংস্কারাচ্ছন্ন শৈলেশ বা ‘কঙ্কণ’ গল্পের মায়াময় মণীশ।
‘পত্নী ও প্রেয়সী’ তাঁর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা প্রথম গল্প। ‘ঈজিচেয়ার’ গল্পে হার্টের অসুখের ছল করে গৃহিণী আরতি দত্ত শয্যাশায়ী।তারই মোহে, তাকে দেখাশোনা করার ছল করে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে আরতির খাটের পাশে ইজিচেয়ারে দিন কাটায় তরুণ উদ্দালক ভৌমিক আর সকাল থেকে রাত কাজে ডুবে থাকে সহকারী চিফ ইঞ্জিনিয়ার ঘুষ না নেওয়া দত্ত সাহেব। এই ছলনা আরতি শুরু করেছিল কিন্তু এতে সে শান্তি পায় না, আবার থামতেও পারে না।
‘আত্মসর্বস্ব’ গল্পে শর্বরীর আত্মসুখী মা-বাবা , ‘নারী -প্রকৃতি’ তে প্রতিভার আত্মকেন্দ্রিক নির্মমতা, অপমান’-এর আত্মগর্বী নিবেদিতার পাশে মমতাময় অনিরুদ্ধরা আশাপূর্ণা দেবীর-ই সৃষ্টি। আর এক অপূর্ব চরিত্র ‘কালো খাতা’-র মিসেস পঙ্কজিনী হালদার – সেকালের ব্রাহ্ম মনোভাবাপন্ন রুচিশীলা রমনী চরিত্রটি কি নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আশাপূর্ণা। ঘরের বাইরের জগত সেভাবে দেখার সুযোগ ছিল না তাঁর। তা সত্তেও কিভাবে যে তাঁর দেখার চোখ এত বিস্তৃত, এত সুগভীর হয়েছিল তা বলা কঠিন।
ছয়ের দশকে আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর ‘একটি দেশলাই কাঠির জন্য’ গল্পটির ইংরেজি রূপান্তর প্রকাশ করেছিলেন ‘কোয়েস্ট’ পত্রিকায়। হিন্দি, মরাঠি, মালয়ালম, অসমিয়া ইত্যাদি ভাষায় তাঁর গল্প অনূদিত হয়েছে। রবীন্দ্র পুরস্কার থেকে জ্ঞানপীঠ সব-ই তিনি পেয়েছিলেন । পেয়েছেন পাঠক আনুকূল্য। তবু আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্য কীর্তির যথার্থ মূল্যায়ন আজ ও হয়নি।।