কেউ বলে তার জন্মস্থান পাটলিপুত্র, কেউ আবার বলেন কুসুমপুর। তবে আর্যভট্টের অন্যতম ভাষ্যকার প্রথম ভাস্করের মতে তাঁর জন্মস্থান অশ্মকা নামে একটি স্থান। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন এই জায়গাটি গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের কাছাকাছি কোন জায়গা, কোনো গবেষকের মতে তিনি জন্ম নেন বর্তমান কেরালার কোন অংশে। ধন্দ রয়েছে তাঁর জন্মের সময়কাল নিয়ে। মোটামুটি জ্যোতিষশাস্ত্র হিসেবে গণনা করে দেখা যায় তিনি জন্মেছিলেন ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে।
অংক শেখার পথের দিশারী আর্যভট্ট। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহ ছিল আর্যভট্টের। কোন কিছু শেখার সুযোগ হারাতেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজে বেড়াত প্রশ্নের উত্তর। কৈশোরকালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। তাঁর জ্ঞান মুগ্ধ করেছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ছাগুলা নামে একটি গ্রামে জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণাক্ষেত্রে স্থাপন করা হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আর্যভট্টের শিক্ষা শুরু হয়েছিল এখান থেকে। তাঁর প্রতিভা, পরিশ্রম, অধ্যাবসায় তাঁকে সবদিক থেকে এগিয়ে দিয়েছিল অনেকখানি।
ভারতবর্ষে তখন গুপ্তযুগ চলছে। রাজা ছিলেন সম্রাট বুদ্ধগুপ্ত। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী একথা তাঁর কানে পৌঁছেছিল। রাজা স্বয়ং আর্যভট্টের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। রাজকীয় আয়োজনে আর্যভট্ট সেই সময় নিজের আবিষ্কারের কথা সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, আকৃতিতে পৃথিবী ছিল গোলাকার। গোলাকার পৃথিবী নিজের অক্ষপথে আবর্তিত হয় বলেই দিন-রাতের পরিবর্তন হয়। রাহুর প্রভাবে চাঁদ ও সূর্যের গ্রাসের ফলে গ্রহণ হয় এই কথা আসলে মনগড়া। সূর্যের গায়ে পৃথিবী ও চাঁদের ছায়া পড়ে সংঘটিত হয় গ্রহণ। শাস্ত্রের বিরুদ্ধে এমন কথা ঘোষণা করার সাহস দেখিয়েছিলেন আর্যভট্ট।
তিনি জানিয়েছিলেন চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই, সূর্যের আলো চাঁদে প্রতিফলিত হয় বলেই পৃথিবী থেকে চাঁদকে আলোকিত দেখায়। শাস্ত্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার পরও আর্যভট্টকে কখনো হেয় প্রতিপন্ন করা হয়নি। তাঁর সম্মান হিসেবে সম্রাট তাঁকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বময় কর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। ৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে আর্যভট্ট তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আর্যভাটিয়া রচনা করেছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেন।
১৮৮টি স্তোত্র সমেত চারটি পদ বা অংশে বিভক্ত ছিল এই গ্রন্থ। প্রথম পদের নাম ছিল দশগীতিকা। প্রথম পদ গণিত পদ। এখানেই তেত্রিশটি শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে অংক আর অংকের সূত্রের কথা। এছাড়াও পাটিগণিত, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি আর দ্বিঘাত সমীকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলিতে ঘাতবিশিষ্ট পদসমূহের সমষ্টির কথাও আলোচনা করা হয়েছিল। এই অংশেই পাই এর মান ৩.১৪১৬ উল্লেখ করেছিলেন আর্যভট্ট। তৃতীয় অংশ ছিল কালো প্রিয়া। আর সর্বশেষ অংশটি ছিল গোল আপদ। এখানে গোলক তত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছিল।
আর্যভট্টের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। আরবেও পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর সাধনার কথা। অষ্টম শতাব্দীর আগেই আরবে পৌঁছে গিয়েছিল আর্যভট্টের গবেষণালব্ধ জ্ঞান। বিখ্যাত ঐতিহাসিক পন্ডিত আলবেরুনী ভারতে এসেছিলেন একাদশ শতকের দিকে। তার ভ্রমণ কথায় তিনি আর্যভট্টের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে আর্যভট্টের কোনো মূল রচনার সন্ধান তিনি পাননি। কিছু উদ্ধৃতি পেয়েছিলেন যা সংকলন করে রেখেছিলেন প্রাচীন ভারতের আর এক প্রখ্যাত মনীষী ব্রহ্মগুপ্ত। বিজ্ঞানী কার্নের উদ্যোগে আধুনিক যুগে সেগুলি পরে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল গ্রন্থগুলি।
বর্তমানে অংকের ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা সর্বাধিক প্রচলিত রয়েছে তা হলেও দশ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে দুই হাতের ১০টি আুঙ্ল গণনার ওপর ভিত্তি করে। দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছিল আর্যভট্টের হাত ধরে। তিনি সংখ্যাকে উপস্থাপনা করার জন্য নিজের মতো করে একটি পদ্ধতির জন্ম দিয়েছিলেন। এখানে সংখ্যাকে প্রকাশ করা হত শব্দ দিয়ে। ব্যঞ্জনবর্ণগুলো ব্যবহার করা হত বিভিন্ন অংক হিসেবে আর স্বরবর্ণের কাজ ছিল অংকের অবস্থান চিহ্নিত করে দেওয়া। প্রাথমিকভাবে এর সঙ্গে আজকের যুগের দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থার মিল না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থার সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। দশমিক পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে তিনিই প্রথম সংখ্যার বর্গমূল ও ঘনমূল নির্ণয়ের গাণিতিক প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছিলেন। দশভিত্তিক গণনা পদ্ধতির প্রধান বিষয়টি হচ্ছে এই শূন্যের ব্যবহার। সে সময় বিভিন্ন দেশে শূন্যের ব্যবহারকে অশুভ বলে মনে করা হতো। এই কুসংস্কার থেকে বিশ্বকে মুক্তি দিয়েছিলেন আর্যভট্টের শূন্যের কার্যকর ব্যবহার এবং দশ-ভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি আবিষ্কার করে অঙ্কের প্রকাশ। স্থানম, দশম, গুণাম অর্থাৎ স্থান থেকে স্থান হতে দশগুণ যা বর্তমানে দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি হিসেবে নির্ধারণ করা হয় তা শুরু করেছিলেন আর্যভট্ট। তিনিই সর্বপ্রথম বীজগণিতকে প্রাচীন ভারতীয়দের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকী ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রকে ভারতবাসী এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়েছিলেন আর্যভট্ট।