রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ অরুন্ধতী দেবী

".....এমন একদিন ছিল যেদিন সেই বিপুল ব্যক্তিত্বের টানে সকল দুঃখ- দারিদ্র্যকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে ২০ টাকা ৩০ টাকা মাইনের শান্তিনিকেতনে কাজ নিয়ে কত মানুষ আনন্দে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আজ সেই ব্যক্তিত্ব নেই। শুধু তার শক্তি ও মাধুর্য রয়েছে তাঁর গানকে ঘিরে। সেই গানকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়ে কেউ যদি একটু আধটু ভুল করেন তবে সেই ভুলের জন্য তাঁকে নিরুৎসাহ করাটা সুবিচারের কাজ নয়। মনে রাখতে হবে যোগ্যতা অযোগ্যতা, ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সবকিছু নিয়ে তাঁরা হাত পেতেছেন রবিতীর্থেরই দাক্ষিণ্যদ্বারে। তাঁদের প্রতি অকরুণ নাই বা হলাম।"- এক সাক্ষাৎকারে এমন ব্যতিক্রমী বক্তব্য অরুন্ধতী দেবীর। যাঁর পরিচয় এক কথায় শেষ হয় না- রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী , অভিনেত্রী, সঙ্গীত পরিচালিকা ও চলচ্চিত্র পরিচালিকা।

বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এই শিল্পীর জন্ম ১৯২৪ সালের ২৯ এপ্রিল, বর্তমান বাংলাদেশে বরিশালে। তাঁর বাবা বিভুচরণ গুহঠাকুরতা ছিলেন উদার মনের মানুষ। "মন্দিরে তিনি যতখানি নিবিষ্ট চিত্তে আরতি দেখতেন, ঠিক ততখানি আগ্রহ নিয়েই ব্রাহ্মসমাজে তখনকার মনীষীদের বক্তৃতা শুনতে যেতেন, চার্চে যেতেন আবার মসজিদেও যেতেন"। অরুন্ধতী ও তাঁর অন্যান্য ভাইবোনদের বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই উদার বাতাবরণ যে সর্বতোভাবে সহায়ক হয়েছিল তা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়।

অরুন্ধতী বড় হয়ে উঠেছিলেন ঢাকায়। খুব ছোটবেলায় যখন তাঁর বয়স মাত্র ছয় তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর' নাটকে অমলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই নাটকে তাঁর গান ও অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন দর্শকেরা। পরিণত বয়সে অরুন্ধতী বলেছিলেন, ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ গানটি যখন গেয়েছিলাম তার কাব্যসৌন্দর্য কিংবা অন্য কোনো অর্থ বোঝার মতো বয়স অথবা বুদ্ধি কোনোটাই হয়নি। কিন্তু ভাটিয়ালির উদাসী সুরে রাঙামাটি, গ্রামছাড়া-এই দুটি কথা চেনা মহলের গন্ডী ছাড়িয়ে মনটাকে যে কোন সুদূরে পৌঁছে দিত তার ঠিকানা পেতাম না। আর সেজন্যই সেই হারিয়ে-যাওয়া পথের প্রতি একটা রহস্যময় আকর্ষণ অনুভব করতাম। গ্রামের শেষপ্রান্ত ছাড়িয়ে ঐ রাঙামাটির পথ কোথায় গিয়ে মিশেছে? সেখানে কি পাহাড় আছে? না আকাশ নেমে এসেছে মাটির বুকে? এইরকম সব বিচিত্র ভাবনায় হারিয়ে যেতাম।.....গান গেয়ে মেডেল পেয়ে আনন্দ হয়েছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় আনন্দে মনটা ভরে ওঠে এখন, যখন ভাবি ছোটবেলায় ঐসব গান গেয়েছিলাম বলেই তো কল্পনার ছোঁয়ায় মনটা এমন রঙিন হয়ে উঠতে পেরেছিল। কল্পনার পটভূমি না থাকলে জীবনে কোনো বড় উপলব্ধির অধিকারী হওয়া যায় না।’

সুকন্ঠী অরুন্ধতীর গান শেখার শুরু শৈশবেই। ঢাকায় থাকতে নিত্যগোপাল বর্মণের কাছে গান শিখতেন। কলকাতায় এসে সুর সাগর হিমাংশু দত্তের কাছে নিয়মিতভাবে শিখেছেন অতুলপ্রসাদী, নজরুলগীতি সহ অন্যান্য। বাংলা গান। ‘সব গানই সমান অনুরাগে গাইতাম এবং শিখতাম’। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁর ভালোবাসা তৈরি হল শান্তিনিকেতনে আসার পর। ‘আমার ছাত্রজীবন কেটেছে ওখানেই। ছোটো পিসেমশাই অজিত চক্রবর্তী শান্তিনিকেতনের শুরু থেকেই ছিলেন। গুরুপল্লীর প্রথম বাড়িটা ছিল তাঁরই। ছোটো পিসেমশাই এবং পিসিমার(লাবণ্যলেখা চক্রবর্তী)দাক্ষিণ্যেই আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত এল ধারাসারে।’ সেই সময় শান্তিনিকেতন ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার কোনো জায়গা ছিল না।" সৌভাগ্যক্রমে আমার শিক্ষার ভার পড়ল শৈলজাদার ওপর, যাঁর মতো গুরু দুর্লভ"। ভর্তির দিনে শৈলজারঞ্জন মজুমদার অরুন্ধতীকে বললেন, তাঁর জানা রবীন্দ্রনাথের যে কোনো একটি গান গাইতে। কেননা রবীন্দ্রনাথ সেই গান শুনবেন তাই যদি কোনো ভুলত্রুটি থাকে তাহলে তিনি শোনার আগেই ঠিক করে নিতে হবে।

“আমি একটাই রবীন্দ্রনাথের গান জানতাম 'উজাড় করে লও হে আমার যা কিছু সম্বল।” গানটি ছিল দেশ রাগের ওপর। শৈলজাদা একেবারে নতুন ছাঁদে ঢেলে সাজিয়ে দিলেন। মাত্র একটা দুপুর সময়। তারই মধ্যে অন্য ঢংয়ে গাওয়াটা সহজ নয়।’ কিন্তু এই কঠিন কাজটিও অনায়াসে করেছিলেন অরুন্ধতী কেননা সে গান যে শুনবেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। “শৈলজাদা গান শুনে খুশি হলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিখিয়ে দিলেন আর একটি গান। যদি তিনি আরো শুনতে চান। গানটি হল ‘আমার কি বেদনা সে কি জানো'।” তারপর এল সেই শুভক্ষণ- " নাট্যঘরে তাঁর সামনে 'উজাড় করে লও হে আমার' শুরু করবার কয়েক মুহূর্ত বাদেই তিনি আমার সঙ্গে সুর মিলিয়ে গুনগুন করে গাইতে লাগলেন। এখন ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তখন তো বুঝিনি কী বিরাট মানুষ আমার সুরে সুর মিলিয়ে গাইছেন। ভাগ্যিস বুঝিনি! তাহলে বোধহয় গলা দিয়ে একটিও স্বর বেরত না। গান শেষ হল। উনি চুপ করে বসে রইলেন। আমি একটু দমে গেলাম। কই আর তো শুনতে চাইলেন না। তাহলে কি আমার গান ওঁর ভালো লাগেনি? অন্তর্যামী ছিলেন তো! সেইজন্যেই হয়ত আমার মনের কথা এক মুহূর্তে বুঝে নিয়ে বললেন, 'আমার আর কি গান জানো?শোনাও।' তখন গাইলাম 'আমার কি বেদনা'।" এ গান শেষ হবার পর কবি আবারও গান গাইতে বললে কিশোরী জানালো, "আর তো জানি না। এই গানটি আজই দুপুরে শৈলজাদা শিখিয়ে দিলেন তাই গাইতে পারলাম"। গানটি সেদিনই শেখা শুনে রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আশ্রমে থাকবে তো? কত মেয়ে আসে, গান শেখে। কি সুন্দর গায়। তারপর একদিন পাখীর মতো ফুরুত করে উড়ে চলে যায়। তুমি যেয়ো না।” কবির চাওয়া পূর্ণ হয়নি। কিন্তু সে পরের কথা।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একসঙ্গে গান শিখেছেন অরুন্ধতী। কীভাবে গান শেখানো হত তাঁদের? কণিকা বলেছেন, ".......ক্ল্যাসিক্যাল গান লেখাটা আমাদের কম্পালসারি ছিল। হেমেন্দ্রলাল রায়, বি.ভি. ওয়াজেলওয়ার, ক্ষিতীশ বন্দ্যোপাধ্যায়- এঁদের কাছে ক্ল্যাসিক্যালের তালিম পেয়েছি। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব, সারা ভারতের বড় বড় গুণী, বীণকার, যন্ত্রী, ওস্তাদ ভীমরাও শাস্ত্রী এঁরা ছিলেন শান্তিনিকেতনের নিত্য অতিথি। এঁদের গানবাজনা শুনেও সঙ্গীতকে নিজের ভাবতে পেরেছিলাম।" এর পাশাপাশি চলত পড়াশোনাও। “১৯৪১ সালে আমি ও অরুন্ধতী একসঙ্গেই ম্যাট্রিক পাশ করি।” দুজনের বন্ধুত্ব ছিল গভীর। তাঁদের দুজনের সঙ্গীত গুরু ছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার সম্পর্কে অরুন্ধতী বলেছেন, "... শৈলজাদা কণিকার সঙ্গে আমারও একসঙ্গে গান শেখার ব্যবস্থা করলেন। নিজেও অবশ্য আলাদা শেখাতেন। কিন্তু তিনি কত বড় উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন আর আমার ভাগ্যটাও কত সুপ্রসন্ন ছিল ভাবা যায় না। না হলে কণিকার মতো অমন গুণী প্রতিভাময়ী শিল্পীর সঙ্গে আমি একসঙ্গে গাইবার অধিকার পাই?” অরুন্ধতী গান শিখেছেন রাজেশ্বরী দত্তর তালিম দেখেও- “তাছাড়া রাজেশ্বরীদি যখন গান শিখতেন তাঁর কাছে বসেও অনেক গান শেখা হয়ে যেত।” তখনকার শান্তিনিকেতনে উৎসবের অভাব ছিল না। “এই উৎসবের সময় কত গান যে শেখা হয়ে যেত! প্রতিটি শিল্পীর জন্য কি পরিশ্রম যে শৈলজাদা করতেন ভাবা যায় না।” এমন শিক্ষক ছিলেন বলেই দু- তিন বছরেই প্রায় ছ’শো গান শেখা হয়ে গিয়েছিল অরুন্ধতীর।

১৯৪২ সাল থেকে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ও প্রমথ চৌধুরী স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে থাকতে শুরু করলেন। সেই সময় অরুন্ধতী ইন্দিরা দেবীর কাছে ভানুসিংহের পদাবলী, মায়ার খেলা সহ আরও অসংখ্য গান শিখেছিলেন। “সঙ্গীত শিক্ষার মধ্যে একটা সুবিন্যস্ত ধারার শুরু তখন থেকেই।” কী ভাবে চলেছিল সেই ধারা? কলেজের অফ পিরিয়ড থাকলেই অরুন্ধতী দৌড়ে চলে আসতেন উত্তরায়ণে। প্রখর গ্রীষ্মের শান্তিনিকেতন- “মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ, পথও অনেকটা। এখনকার শান্তিনিকেতন আর তখনকার শান্তিনিকেতনে অনেক তফাৎ।“গানের টান এমনই যে সব অসুবিধে তখন তুচ্ছ।“ বিবিদি হয়ত খেতে বসেছেন, কী রান্না করছেন। আমাকে দেখলেই বলতেন 'ঐ টিপয়ের ওপর খাতা-পেন্সিল আছে। নোটেশন করে নাও। আমি সুর তোলার সঙ্গে সঙ্গে স্বরলিপি করে নিতাম।” এই যে নতুন গান শেখা হল, সেসব পৌঁছে দিতে হত শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে।” বিবিদির কাছে তোলা গানগুলি তিনি আবার নতুন করে নোটেশন করতেন।” এইভাবে অজস্র গান শুধু শেখা হয়ে গিয়েছিল অরুন্ধতী দেবীর তাই নয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভান্ডারও সমৃদ্ধ হয়েছিল। “শৈলজাদা আমাদের কেবল উসকে দিতেন- উনি(ইন্দিরা দেবী) হলেন গুরুদেবের গানের খনি। ওঁর কাছ থেকে যত পারো আদায় করে নাও।” এই 'আদায় করা' আদৌ সম্ভব হত না, যদি না ইন্দিরা দেবীরও নিজেকে উজাড় করে দেবার অতটা আগ্রহ থাকত। শান্তিনিকেতনে অরুন্ধতী গান শিখেছেন সুবিনয় রায়, ইন্দুলেখা দেবী, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, নীলিমা সেন প্রমুখের সঙ্গে- “সেসব দিনগুলো ছিল যেন আনন্দপাথারে সাঁতার কাটার দিন।" গানের পাশাপাশি নাচও শিখেছেন অরুন্ধতী। শিখেছেন গুরু ব্রজবাসী, বালকৃষ্ণ মেনন প্রমুখের কাছে।

কলকাতায় যখন 'গীতবিতান সঙ্গীত শিক্ষায়তন' প্রতিষ্ঠা করা হল, তখন অর্থসংগ্রহের জন্য নৃত্যনাট্য 'মায়ার খেলা'-র অভিনয় করা হয়েছিল। শুভ গুহঠাকুরতার উদ্যোগে সেই অভিনয়ে “নীলিমা সেজেছিল অমর, অরুন্ধতী শান্তা, আমি ছিলাম প্রমদার রোলে। বিবিদি, শৈলজাদার তত্ত্বাবধানে।”- বলেছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আমন্ত্রণ এসেছিল রেডিয়োতে গান গাইবার জন্যেও। রেডিয়োয় তখন গান গাইলে সম্মান- দক্ষিণা দেওয়া হত। সেই কারণে নারাজ হলেন অরুন্ধতীর মা। কিন্তু শৈলজারঞ্জন মজুমদার বললেন, “গুরুদেবের গানের অতবড় ঐশ্বর্যলোকের খবর ক'টা মানুষই বা জানে? তোমরা শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা যদি মাঝে মাঝে গাও তাঁর গানের সঙ্গে সবারই পরিচয় হবে।” মনে রাখতে হবে এসব সেই যুগের কথা যখন পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ছিল না, ছিল না যত্রতত্র যে কোনও কারণে, যে কোনও অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার হিড়িক। রবীন্দ্রনাথের গান তখনও অনেকের কাছে 'মেয়েদের গান'।" ১৯৪০ সাল(যতদূর মনে পড়ে) সকাল সাতটা থেকে সাতটা পনের এবং সন্ধ্যাবেলা সাড়ে সাতটা থেকে আটটা অবধি রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারিত হত। মাসে দু’বার করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম করতাম আমি, সুচিত্রা, কণিকা, নীলিমা ও হেমন্তবাবু।” অরুন্ধতী দেবীর প্রথম রেকর্ড ‘পথে চলে যেতে যেতে’ তারপর ‘আকাশতলে দলে দলে’, ‘ওগো আমার চির অচেনা পরদেশী’ ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথের চাওয়া অপূর্ণ রেখে চলচ্চিত্র পরিচালক প্রভাত মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করে অরুন্ধতী শান্তিনিকেতন থেকে চলে গেলেন। সরে গেলেন সঙ্গীত পরিবেশনের জগৎ থেকেও। “১৯৪৬ সালে পারিবারিক কারণে আমায় গান বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সেই সময় কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত আমি অনুবাদ করেছি।”

দিল্লি, মুম্বাইয়ের অবাঙালি মহলে সেই অনুবাদ বিশেষ আদৃতও হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর অনশন ভঙ্গ উপলক্ষে অরুন্ধতী দেবীর ডাক এসেছিল গান গাইবার। তিনি শুনিয়েছিলেন গান্ধীজীর প্রিয় দুটি গান ‘আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো’ আর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’। মহাত্মাজীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে, রেডিয়োর শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানেও অরুন্ধতী দেবী গান গেয়েছিলেন। গান গেয়েছিলেন একাধিক চলচ্চিত্রেও।

ছবি আঁকার প্রতিও গভীর আকর্ষণ ছিল অরুন্ধতীর। তিনি যখন শান্তিনিকেতনের ছাত্রী সঙ্গীতভবন তখন সবে গড়ে উঠছে। কিন্তু কলাভবন রীতিমতো জমজমাট। নন্দলাল বসুর সারাক্ষণের ধ্যানপীঠ ছিল ঐ কলাভবন।" অরুন্ধতীর মন কেড়েছিল এই ছবির জগৎ। "..... সবচেয়ে মন দিয়েছিলাম বোধহয় ছবি আঁকাতে। হয়ত বা মনের মধ্যে অস্ফুট বাসনা ছিল ছবি আঁকাকেই জীবিকা রূপে গ্রহণ করবার।" তা অবশ্য হয়নি। তবে ছবি আঁকা ও ছবি দেখার প্রতি টান তাঁর আমৃত্যু ছিল।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী শিল্পের কোনও একটি ধারাতেই নিজেকে বেঁধে রাখেননি। রাখতে চানওনি। চলচ্চিত্র পরিচালক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। আর্থিক সংকটের মোকাবিলা করতে অরুন্ধতী যুক্ত হলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। গায়িকা হলেন নায়িকা। ১৯৫২ সালে প্রবোধকুমার সান্যালের কাহিনি অবলম্বনে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবিতে অরুন্ধতী হলেন নায়িকা। ছবিটি হিন্দিতেও হয়েছিল। প্রবল জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। এরপর দেবকী কুমার বসুর ' নবজন্ম', অসিত সেনের 'চলাচল' 'পঞ্চতপা', প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ' মা', 'মমতা', 'বিচারক', 'আকাশপাতাল', তপন সিংহের ' কালামাটি', 'ঝিন্দের বন্দী', ' জতুগৃহ' ইত্যাদি বহু ছবিতে তাঁর ব্যতিক্রমী অভিনয় দর্শকচিত্ত জয় করেছিল। ১৯৬৩ সালে 'ভগিনী নিবেদিতা' ছবিতে তাঁর অসামান্য অভিনয়ের জন্য তিনি বি.এফ. জে.এ পুরষ্কার পেয়েছিলেন। সুচিত্রা সেনের সমকালে তিনি আভিজাত্যপূর্ণ অভিনয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে এক স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করেছিলেন।

১৯৫৭ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অরুন্ধতীর যাবার কথা থাকলেও বাধা দিয়েছিলেন প্রভাত মুখোপাধ্যায়। সব বাধা তুচ্ছ করে অরুন্ধতী গেলেন বার্লিন। সেখানে তখন ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবি নিয়ে গিয়েছেন তপন সিংহ। তারপর? শোনা যাক তপন সিংহের কথাতে- “এক দীর্ঘ ও নির্জন সন্ধ্যায় অরুন্ধতী মুখার্জি ও আমি বসেছিলাম পার্কে। তাঁকে একটা গান গাইতে অনুরোধ করলাম। অরুন্ধতী গাইলেন 'পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে'। ......বার্লিনের সেই সন্ধ্যায় এক গানেই মাত করেছিলেন অরুন্ধতী। আমিও কাত হয়ে গেলাম, পরের ইতিহাসে শ্রীমতী অরুন্ধতী মুখার্জি হলেন শ্রীমতী অরুন্ধতী সিংহ।" দুই গুণী ব্যক্তির মিলিত জীবন বড় সুখের হয়েছিল।

১৯৬৭ সালে বিমল করের ' খড়কুটো' উপন্যাস অবলম্বনে ' ছুটি' ছবি দিয়ে অরুন্ধতী দেবীর চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু হয়। এই ছবিতে তিনিই ছিলেন চিত্রনাট্য কার এবং সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন অরুন্ধতী দেবী। নবাগতা নন্দিনী মালিয়া ও মৃণাল মুখোপাধ্যায় জুটির অনবদ্য অভিনয়ে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের অপূর্ব প্রয়োগে ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্র ধারায় এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়ের সূচনা করল। ছবিটি সাহিত্যভিত্তিক শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরষ্কার পেয়েছিল। এরপর 'মেঘ ও রৌদ্র', ' পদিপিসির বর্মী বাক্স', ' দীপার প্রেম' ইত্যাদি ছবিতে তিনি তাঁর স্বাতন্ত্র্যের সাক্ষর রেখেছেন। একাধিক চলচ্চিত্রে তিনি সুরারোপও করেছিলেন। নিজে গান গেয়েছেন 'সুরের আগুন' ও 'হারমোনিয়াম' ছবিতে।

অরুন্ধতী দেবীর ছবিতে গানের শিল্পিত প্রয়োগ তাঁর সঙ্গীতপিপাসু রুচিসম্পন্ন মনটিকে তুলে ধরে। চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “শুধু আমি নয় যে কোনো সঙ্গীত পরিচালকই এ সঙ্গীতকে ছবির কাজে সুষ্ঠুভাবে লাগাতে পারেন। কারণ, আমাদের প্রতিটি অনুভূতির, জীবনের প্রতি মুহূর্তের সংখ্যাতীত গান আছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভান্ডারে।” রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী ও গায়কী বিষয়ে অরুন্ধতী দেবীর ভাবনা ছিল স্বতন্ত্র। “.....শিল্পী নির্বাচনের ব্যাপারেও আমি কোনো বাঁধাধরা কোড বা ডগমায় বিশ্বাসী নই। অমুক, অমুক শিল্পী গাইলেই এ গানের প্রকাশভঙ্গি রাবীন্দ্রিক হবে, অমুক গাইলে হবে না এই মনোভাবের চেয়ে অরাবীন্দ্রিক আর কিছু হতে পারে না। যে কেউ সুকন্ঠের অধিকারী হলেই রবীন্দ্রনাথ নিজের গান তাকে গাইবার অধিকার দিতেন।.... কন্ঠ, অনুভূতি এবং পরিশীলিত স্বর থাকলেই যথেষ্ট।“ তিনি বিশ্বাস করতেন ‘শিক্ষিত কন্ঠের গান চিরকাল থেকে যাবেই।’

শান্তিনিকেতনের শিক্ষার রং তাঁর মর্মে, সকল কর্মে জড়িয়ে ছিল।এই সর্বতোভাবে ব্যতিক্রমী শিল্পী বলেছেন, “সঙ্গীত আমার প্রফেশন নয়, আনন্দের আকাশ। আর এজন্য আমি আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ, আর্ট যখন জীবিকা হয়ে ওঠে তখন স্বাভাবিক নিয়মেই তার সঙ্গে এমন কতকগুলি বেসুরো ব্যাপার জড়িয়ে পড়ে যে, শিল্পীকেও অশিল্পীজনক আচরণ করতে হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত যদি আমার জীবিকা হয়ে উঠত হয়ত নানান ঘটনা ও পরিস্থিতির চাপে এমন কাজ করে বসতাম যেটা হত অরাবীন্দ্রিক।”

শৈলজারঞ্জন মজুমদার একবার বলেছিলেন, “নুকু( অরুন্ধতী) যদি শুধু গান নিয়ে থাকত তাহলে আমার দুই ছাত্রীর স্থান হত একই আসনে।” অজস্র গুণের অধিকারী অরুন্ধতী দেবীর আত্মমর্যাদাবোধ এতটাই প্রবল ছিল যে সেন্সর করা ছবি প্রযোজক আবার এডিট করায় টাইটেল কার্ড থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করতে দ্বিধা করেননি। তাঁর এই আভিজাত্যবোধ তাঁকে সাধারণের থেকে পৃথক আসনে বসিয়েছিল। তপন সিংহের মতো পরিচালকও বলেছেন, “আমি ওর থেকে অনেক কিছু শিখেছি।" পরিবার এবং কর্ম জগত দুই-ই সমানতালে সামলেছেন অরুন্ধতী। সন্তানদের বড় করেছেন কড়া শাসনে।

সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর সামান্য সুস্থ হয়েই কাজে যোগ দিয়েছিলেন অরুন্ধতী দেবী। মৃত্যু এল আকস্মিক ভাবে, এল একলা ঘরে। কেউ জানল না কীভাবে ঝরে গেল এক আশ্চর্য জীবন। সেদিন ছিল ১৯৯০ সালের ৩১ জানুয়ারি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...