কোলাঘাট থেকে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা গ্রাম। তার পাশেই নয়াগ্রাম। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে এই দুই গ্রামের নাম আলাদা করে চোখে পড়ে। সাড়া বিশ্বের শিল্পপ্রেমি মানুষদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
ভীষণ রঙিন দুটি গ্রাম।এই দুই গ্রামের বাতাসে মিশে ছবি, গান আর মেঠোসুরের গন্ধ। লাল মাটির দেওয়াল রঙিন হয়ে থাকে রং তুলিতে। গ্রামে পা রাখলেই চোখে পড়ে রং-তুলিতে নিবিষ্ট শিল্পী। দেওয়ালে দেওয়ালে কথা বলে উঠে ছবির কথামালা। মোটা তুলির রেখায়, উজ্জ্বল রঙের প্রয়োগে চোখ টেনে নেওয়া ছবিঘরগুলো।
প্রায় ২৫০ জন পটশিল্পী আছেন এই দুই গ্রামে। নয়া আর পিংলা বাংলায় পট শিল্পের আখর।
পট চিত্র শুধু ‘চিত্র’ নয়। তার সঙ্গে থাকে গানও। লোককথা, পাঁচালি, উপকাব্য, প্রচলিত গল্প নিয়ে গান বাঁধেন শিল্পীরা। তারপর সেই গানের কথার সঙ্গে সঙ্গে চলে ছবি আঁকা।
আগে যে শিল্পী গান বাঁধতেন সেই শিল্পীই পট আঁকতেন। কিন্তু এখন সেই প্রথা পাল্টেছে। অনেক পটশিল্পীই শুধু পট এঁকে দেন। গান বাঁধেন অন্য কেউ।
গান, ছবির কথাতেও এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন ঘটেছে রঙের ব্যবহারেও। গাছের ফুল, পাতা, মাটি ইত্যদি দিয়ে রং তৈরি করা হত। এখন পটে ফেব্রিক রং ব্যবহার করেন অনেকে। নারকেলের মালায় বেলের আঠার সঙ্গে ফল-ফুল মিশিয়ে তৈরি হয় প্রাকৃতিক রং। পট শিল্পরা দাবী করেন রং-আঠা-জলের পরিমাণ যদি ঠিক হয়, তা হলে তা ৫০০ বছরেও নষ্ট হবে না পটের ছবি।
পটচিত্রে বেশ কিছু নির্দিষ্ট রঙের ব্যবহার হয়। তার বাইরে অন্য রঙের ব্যবহার সেভাবে দেখা যায় না। আগে লাল রং তৈরি হত সেগুন গাছের পাতা দিয়ে। তা অমিল হলে, পান খাওয়ার খয়েরের সঙ্গে চুন মিশিয়ে নেওয়া হত। অপরাজিতা ফুলের পাপড়ি থেকে নীল। সিম, বরবটি, বা ঘন সবুজ গাছের পাতা বেটে শিল্পীরা তৈরি করতেন সবুজ রং। কাঁচা হলুদ গাছ থেকে হলুদ আর বাঁশ বা চাল পুড়িয়ে কালো রং। পুঁই গাছের ফল দিয়ে গোলাপি রং। কালোজামের রস থেকে বেগুনী। শাঁখ আর মাটি থেকে সাদা। খড়িমাটি ও লালচে রঙের জন্য থাকত উনুনের গায়ে পোড়ামাটি।ছাই রঙের জন্য উনুনের কয়লার ছাই।
পট আঁকার জন্য মোটা বা সরু ধরনের তুলি করা হয় বাচ্চা ছাগলের ঘাড়ের বা পেটের লোম দিয়ে। বিশেষ করে সরু তুলির জন্য কাঠবেড়ালির লোম বা বেজির লেজের চুল ব্যবহার করা হয়।
পরিবর্তন ঘটেছে পটের গানের বিষয়বস্তুতেও। আগে বিভিন্ন আসরে পটের গানের আসর বসত। সেখানে রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য বা পাঁচালির পাঠকে কাব্যরূপ দিতেন পটশিল্পীরা। চাঁদ সদাগরের বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, কিংবা চণ্ডীমঙ্গল বা সাবিত্রী সত্যবানের মতো পুরাণ কাহিনি নিয়ে শ্রাব্য-দৃশ্য দুই চলত একসঙ্গে। শ্রোতা-দর্শকরাও শুনতে চাইতেন। কিন্তু এখন রুচি বদলেছে। দর্শক টেনে রাখতে এখন পটের গানে কথককথা ছাড়াও সামাজিক বিষয় নিয়ে গান বাঁধতে হয়। তাঁরা এখন সমকালীন ঘটনাকেও পটের মধ্যে তুলে ধরেছেন।পণপ্রথা, নারী নির্যাতন, এইডস, পালস পোলিওর মতো সামাজিক বিষয়গুলিও তাঁদের শিল্পকর্মের মধ্যে থাকছে। এমনকি সুনামী, নোটবন্দীর মত বিষয়ও উঠে আসছে।
পট সাধারণতঃ তৈরী হত কাপড় দিয়ে। থান কাপড় থেকে মাপ মতো কেটে তার সঙ্গে তেঁতুল বিচির আঠা আর চকের গুঁড়ো মিশিয়ে, রোদে শুকিয়ে পট বানানো হত। সেই প্রথা আজও চলে আসছে। কিন্তু এখন কাপড়ের পাশাপাশি কাগজের পটও হয়।
টি-শার্ট থেকে শুরু করে কাপ-প্লেট, ছাতা কিংবা ঝাড়বাতি সব কিছুতেই ছকভেঙ্গে পটের তুলি টান।
বিভিন্ন মেলায় দেখা যায় তাঁদের। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছেন তাঁরা। লন্ডন, প্যারিস, নরওয়ে সুইডেন থেকে শুরু করে দিল্লি, মুম্বই এর বিভিন্ন প্রদর্শনী সর্বত্রই দেখা যায় পিংলা ন্যাগ্রামের শিল্পীদের। বহু বিদেশী পর্যটক আসেন এখানে। অনেক শিল্পী ওয়ার্কশপ করেন।
বিভিন্ন এনজিও’র সাহায্য নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন পিংলা- নয়াগ্রামের পটশিল্পীরা। ঐতিহ্য বাঁচাতে কাজে লাগাচ্ছেন প্রযুক্তিকে। তৈরি করেছেন নিজেদের ওয়েবসাইট। নিজেদের শিল্পকে সাড়া পৃথিবীর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটকে কাজে লাগাচ্ছেন।
"চিত্রতরু" নামে শিল্পীদের একটি সংস্থাও আছে। প্রতি বছর নভেম্বরে "পট মায়া" নামে মেলার আয়োজন করেন শিল্পীরা। দেশ-বিদেশ থেকে বহু মানুষ আসেন।