সময়টা ১৯২৬ - হাওড়ায় জন্ম হয়েছিল এমন এক বিশ্ব বরেণ্য চিত্র শিল্পীর - যিনি বুঝিয়েছিলেন যে , শিল্পী সত্ত্বার সাথে একটা ঐতিহাসিক চোখ ও মনন থাকা প্রয়োজন । যার কাছে বয়েস ছিল শুধুমাত্র সংখ্যা, আর সেই সংখ্যাকেই জয় করে পুরোনো কলকাতার সাথে নতুন কলকাতার বদলে যাওয়ার ছবি যিনি সূক্ষাতিসূক্ষ ভাবে তুলে ধরেছিলেন, তিনি প্রখ্যাত শিল্পী- রথীন মিত্র।
সে এক অমর সৃষ্টি। রাধারমণ মিত্রের 'কলিকাতা দর্পন' তাঁকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল -তখন থেকেই ইতিহাস স্থাপত্যকে রেখায় তুলে নেওয়ার প্রবণতা প্রগাঢ় হয়েছিল, যা গতি প্রাপ্ত হয়ে পূর্ণতা পায় তার অবসরের পর। আর তাই রং ছাড়াই ইতিহাস প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো তার হাতের টানে।
রাধারমণ মিত্রের ‘কলিকাতা দর্পণ’কে সঙ্গী করে পুরোনো কলকাতার ইতিহাসকে খুঁজে বের করতেন রথীন মিত্র। এঁকে নিতেন স্কেচবুকে। দেশে-বিদেশে বহু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন চিত্রশিল্পের শিক্ষকতা করেছেন। অর্জন করেছেন একাধিক কালজয়ী সম্মান । শুধু শিল্পী নয় শিক্ষক ও মানুষ হিসেবেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন । দেরাদুনের বিখ্যাত দুন স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পর শেষে ফিরেছেন কলকাতায়। বয়েস বাড়লেও শিল্পীর কর্মোদ্যোগে ভাটা পড়েনি । প্রথম দিকে ‘কলেজস্ট্রিট’ পত্রিকায় তিনি কলকাতার এক-একটি স্থাপত্যের ছবি প্রকাশ করতেন যার ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতেন বিশিষ্ট শিল্প-ঐতিহাসিক, সম্পাদক প্রশান্ত দাঁ।
তার সৃষ্টির অমরত্বের জন্য কলকাতা দূরদর্শের ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। কলকাতার তিনশো বছর উপলক্ষ্যে কলকাতা দূরদর্শনে একটি ‘ক্যালকাটা নাউ অ্যান্ড দেন’ ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় ঠিক হয়, ডালহৌসি থেকে শুরু করে কলকাতা জুড়ে কলোনিয়াল পিরিয়ডের এবং কলোনিয়াল গড়নের যে বিখ্যাত ইমারতগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, সেগুলোর ছবি আঁকবেন রথীনবাবু। এইসব স্থাপত্যের পুরোনো ছবি প্রাথমিকভাবে সাহেব চিত্রশিল্পীর আঁকা ও যা সংরক্ষিত আছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। রথীন বাবু ঠিক করেন সেইসব ছবি আগে দেখবেন ও পরে সাম্প্রতিক চিত্রের বাস্তব রূপ দেবেন। যাতে শহরের গায়ে সময়ের বদল সহজেই ধরা পড়ে। এই স্কেচগুলো জীবন্ত ইতিহাসের হারকিউলিয়ান কাজ। ক্যাথেড্রাল চার্চ, হগ মার্কেট, খিদিরপুর ব্রিজ, এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা মাদ্রাসা, কার্জন পার্ক, টাউন হল , ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কি নেই সেখানে ? শহরের পুরোনো সব স্থাপত্য, ইতিহাস গাঁথা আছে রেখায়।এতো গেলো কলকাতার কথা। এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দ, ভারতবর্ষের যে-যে বাড়িতে থেকেছেন, শ্রী চৈতন্য , সিস্টার নিবেদিতার স্মৃতি বিজড়িত স্থানের ছবি এঁকে এনেছিলেন তিনি । কলকাতা ছাড়াও এঁকেছেন দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, উত্তরাখণ্ডের মন্দিরসহ একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ছবিও। শিল্পীর এই পুরাতন ভবনগুলির অভূতপূর্ব স্কেচগুলি কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তারা ১৯৮০ এর একেবারে শেষের দিকে আগ্রহী হয়ে হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের একটি তালিকা প্রকাশ করে। এছাড়াও স্কেচগুলি সংক্ষিপ্ত নোটসহ অনেকগুলি স্থানীয় এবং ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে তার সৃষ্টি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনাও চলছে।
কিন্তু কালের নিয়মেই নক্ষত্র পতন ঘটে । ৯৫ বছর বয়সের অভিসন্ধিৎসু এক সমৃদ্ধশালী ইতিহাস- ঐতিহ্যের ব্যাখ্যাকারের দীর্ঘ এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো ১৯শে অগাস্ট , ২০১৯ । তবে শিল্পীর মৃত্যু হলেও তার সৃষ্ট শিল্পের মৃত্যু নেই, তা অমর আর তাতেই শিল্পী বেঁচে থাকবেন । বদল তো ধর্ম -যুগের হাওয়ায়,গতিশীলতায় এই শহর আরো বদলাবে। কিন্তু এই শহর খুঁজবে বদলের রূপকারকে ।