বাংলা টেলিভিশনের দুনিয়ায় ঝড় উঠেছে অনেকদিন আগেই। ঝড় শুধু তার জনপ্রিয়তার নয়, ঝড় উঠেছে অভাবেরও। বিষয়টি নিয়ে এর আগেও বহু লেখালিখি হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও প্রাপ্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না কলাকুশলীরা। শুধু ছোটপর্দাই নয়, বড়পর্দাও শিকার হয়েছে এই পরিস্থিতির। এই ইস্যুটিকে কেন্দ্রে রেখে গতবছর অনেক টানাপোড়েন শুরু হয় টলি পাড়ায়। কাজ বন্ধ থাকার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে, অনেক ধারাবাহিকের পুনঃসম্প্রচার দেখিয়েছে চ্যানেল। এরপর রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতায় পরিস্থিতি আয়ত্বে আসে। বেশ কিছু প্রযোজনা সংস্থা বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেয় শিল্পীদের। এরপর আবার পুরোদমে কাজ শুরু হয় টলি পাড়ায়। তবে, সমস্যা পুরোপুরি মিটে যায়নি এখনও পর্যন্ত। দোলাচল একটা আছে। এই নিয়ে দফায় দফায় মিটিং-ও হচ্ছে আর্টিস্ট ফোরামের দফতরে। আর এই মুহূর্তে আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে একটি নাম- ‘দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া’। এই প্রযোজনা সংস্থার তত্বাবধানে যে ধারাবাহিকগুলি চলত সেগুলির হাল আজ বেহাল। বন্ধ হয়ে গিয়েছে ‘আমি সিরাজের বেগম’, ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’। চলছে ‘জয় বাবা লোকনাথ’, ‘মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য’ এবং ‘খনার বচন’। শেষ হওয়ার আগে ‘আমি সিরাজের বেগম’ হস্তান্তরিত হয় শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর দফতরে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বলা ভাল, বেশ তাড়াহুড়োর সঙ্গেই বন্ধ করে দেওয়া হল এই ধারাবাহিক। ওদিকে ‘মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য’ হাতবদল হয়ে চলে গিয়েছে সুরিন্দর ফিল্মস-এর ঘরে। ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্র অর্থাৎ নিমাইয়ের চরিত্রে যিনি অভিনয় করতেন অর্থাৎ শুভ রায়চৌধুরী বকেয়া টাকা না পাওয়ায় চরিত্র থেকে সরে এসেছেন। অবশ্য সুরিন্দর ফিল্মসের কাছে তাঁর কোনও টাকা পড়ে নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। ‘দাগ মিডিয়া’র কাছে অনেক টাকা তাঁর পাওনা। একইভাবে জয় বাবা লোকনাথ, খনার বচন সহ অন্যান্য ধারাবাহিকের কলাকুশলীরা তাঁদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত। বিষয়টি মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় আজ এক জরুরিভিত্তিক সাংবাদিক বৈঠকের আয়োজন করে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মোশন পিকচার্স আর্টিস্ট’স ফোরাম’। হাজির ছিলেন ফোরামের কার্যকরী সভাপতি প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়, ফোরামের সম্পাদক অরিন্দম গাঙ্গুলি সহ শঙ্কর চক্রবর্তী, ভরত কল, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, রূপা ভট্টাচার্য, সৌমিলি বিশ্বাস, দিগন্ত বাগচি, লামা, পার্থসারথি দে, সোহন মুখোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে।
সভায় জানা যায়, প্রায় এক কোটি তেত্রিশ লক্ষ টাকা শুধুমাত্র শিল্পীদের পারিশ্রমিক বাবদ বাকি। এখন কথা হল, একটা মেগা সিরিয়ালের সঙ্গে তো শুধুই শিল্পীরা জড়িয়ে থাকেন না, থাকেন বহু ফ্লোর ম্যানেজার, মেক আপ আর্টিস্ট, হেয়ার ড্রেসার, আর্ট ডিজাইনার সহ আরও অনেকে। দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়ার ঘরে আজও এঁদেরও বহু টাকা বন্দি হয়ে আছে। দাগ-এর কাছে প্রাপ্য টাকা চাইতে গেলে তারা ঠেলে দিচ্ছে চ্যানেলের দিকে। বক্তব্য, চ্যানেলের কাছে রয়েছে টাকা। উল্টোটাও ঘটছে। চ্যানেলও ঠেলে দিচ্ছে প্রযোজনা সংস্থার দিকে। দিনের শেষে ভুগছেন শিল্পীমহল সহ ইউনিটের অন্যান্য ব্যক্তিরা।
গল্প এখানেই শেষ নয়। দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া গত ২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পারিশ্রমিক থেকে প্রায় ২০-২৫ লক্ষ টাকা টিডিএস বাবদ কেটে নিলেও আজ অবধি একটি টাকাও জমা পড়েনি সরকারি কোষাগারে। শুধু দাগ মিডিয়াই নয়, আরও বেশ কিছু প্রযোজনা সংস্থার মধ্যেও এই প্রবণতা রয়েছে বলে জানান অরিন্দম গাঙ্গুলি।
প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় জানান- “এই অবস্থা অবিলম্বে না কাটলে আমরা বড় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব। নিজের প্রাপ্য টাকা পাওয়ার জন্য শিল্পীরা ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়েছে এক প্রকার। এঁদের পরিশ্রমের কোনও দাম নেই? আর যারা দিনরাত ফ্লোরে কষ্ট করেন? তাঁদের কী হবে? এরকম ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়াকেন্দ্রিক এই গোটা বিষয়টিই প্ল্যানমাফিক করা হয়েছে। এটা একটা গেম প্ল্যান। চ্যানেল লিখিত দিয়েছে যে তাদের কাছে টাকা দেওয়া আছে প্রযোজকের তরফে। কিন্তু সেই টাকাটা কোথায়? চ্যানেলের বক্তব্য প্রযোজকের NOC ছাড়া টাকা দেওয়া যাবে না। কিন্তু সেই প্রযোজক যদি টানা ৬ মাস ধরে বেপাত্তা থাকে তা হলে কী করে টাকাটা পাওয়া যাবে?”
প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় আরও জানান, আমরা যারা শিল্পী তাঁরা প্রত্যেকে প্রতিষ্ঠিত নন। কেউ কেউ ব্যাপারটা সামলে নিতে পারছেন কেউ পারছেন না।
অরিন্দম গাঙ্গুলিরও একই বক্তব্য, তিনি জানান- “আর্টিস্ট ফোরাম দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়ার এই অপচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই সমস্যাটির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রচেষ্টা চালাবে। এর জন্য যদি প্রয়োজন পড়ে তবে তাঁরা গণ আন্দোলনে শামিল হবেন। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে”।
সাংবাদিক বৈঠকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে যে গত আর্থিক বর্ষে দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়ার সঙ্গে যে সব মানুষ কোম্পানির তরফ থেকে যুক্ত ছিলেন অর্থাৎ কোম্পানির মালিক, বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের সদস্যরা এবং প্রযোজনা নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে আর্টিস্ট ফোরামের আর কেউই যুক্ত থাকবেন না। কারণ এঁদের সক্রিয় ভূমিকার জন্যই আজ শিল্পী ও কলাকুশলীরা চরম আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন।