মাত্র দু’বছর বয়সে হারিয়েছিলেন মাকে। বড় হয়ে ওঠা ঠাকুমার কাছে। উত্তর কলকাতার চাঁপাতলা ঘাটে ঠাকুমার সঙ্গে স্নান করতে যেতেন। গঙ্গা বড় টানত। জল নিয়ে খেলা করতে খুব ভালোবাসতেন ওই বয়সেই। শিশুর চাপল্যে জল ছোঁয়ার অভ্যাসই একদিন ছোট্ট মেয়েটিকে করে তুলেছিল এশিয়ার সেরা সাঁতারু।
বাবার চোখে পড়ে যায় জলের প্রতি মেয়ের টান। বাবা পাঁচুগোপাল সাহা চাকরি করতেন সেনা বিভাগে। ভর্তি করে দেন হাটখোলা সুইমিং ক্লাবে। ছোট্ট মেয়ের জলপোকা স্বভাব দেখে হীরে চিনতে সময় লাগেনি আর এক প্রথিতযশার। তিনি শচীন নাগ। দেশের হয়ে এশিয়ান গেমসে প্রথম সোনা এনেছিলেন।
আরতি সাহার জলজীবনের প্রথম ট্রেনিং শুরু হয় তাঁর কাছেই।
১৯৪০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। জন্ম কলকাতায়। মধ্যবিত্ত পরিবার। উত্তর কলকাতার গলি-পথ হেঁটে বড় হয়ে ওঠা। বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে বয়ে যেত গঙ্গা। ছোট্ট আরতির মন পড়ে থাকত সে দিকেই।
বয়স যখন ৫ তখন থেকেই অংশগ্রহণ করতে শুরু করলেন সাঁতার প্রতিযোগিতায়।
সন ১৯৪৮। স্বাধীনতা, দেশভাগ, অস্থিরতায় বিপর্যস্ত চারপাশ। তার মধ্যেই নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন বালিকা আরতি। একের পর এক পুরস্কার। জলে তার সঙ্গে পাল্লা দেয় কলকাতায় এমন মানুষ ক্রমেই বিরল হয়ে উঠতে লাগল। এমনকি দেশের সমস্ত বড় প্রতিযোগিতাতেও অপ্রতিরোধ্য আরতি। ওই বছরেই ডলি নাজিরের রেকর্ড ভাঙ্গলেন। ওই বছরেই স্টেট লেভেলে নিজেই নতুন রেকর্ড গড়লেন।
১৯৫২-তে শুরু আন্তর্জাতিক সফর। ফিনল্যান্ডের সামার অলিম্পিকে সুযোগ পেলেন। ভারত থেকে সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু হিসেবে। ডলি নাজিরের সঙ্গে। বড় সাফল্য না এলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরিচিতি পেলেন। দেশে ফিরেই আর এক দুর্যোগের মুখে। হারালেন ছোটবোন ব্রততীকে। মা-হারা আরতির কাছে এ শোক সহজ ছিল না। মন বশ মানতে চায়না। শুশ্রূষা দিল সাঁতার। ফিরে গেলেন জলের আশ্রয়ে।
ভারতীয় মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল অভিযানে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন ছ’ বারের বিজয়ী ব্রজেন দাস। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য টাকার জোগাড় করতে হিমশিম হতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।
প্রথমবার একটুর জন্য অধরা থেকে গিয়েছিল ইংলিশ চ্যানেল। দ্বিতীয়বার তাঁর ম্যানেজার অরুণ গুপ্ত অসুস্থ। কিন্তু এবার আর হার মানেননি। আরতি ছুঁতে পেরেছিলেন সাফল্যের শীর্ষ। এশিয়ার প্রথম মহিলা হিসেবে ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯-এ ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলেন তিনি।
সাড়া পড়ে গিয়েছিল বিশ্বে। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দিল্লির তিনমূর্তি ভবনে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
কপালে লাল টিপ, নাকে নাকছাবি, গায়ে গয়না। এই ছিল তাঁর চেনা চেহারা। নিজেকে এভাবেই দেখতে ভালোবাসতেন তিনি। নিজের মধ্যে যুদ্ধ জয়ের আগুনটাকে এভাবেই যেন পুষে রাখতে ভালোবাসতেন তিনি।