"রেলগাড়ি দেখতে যাবি?"।
সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী সিনেমা। অপু-দুর্গা। দারিদ্র, অভাবের অন্ধকারে পাক খেতে থাকা শৈশবের সারল্য ভরা প্রশ্ন। একগুচ্ছ কাশফুল মাথা দোলাচ্ছে। উৎসবের আগমনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। প্রকৃতি এভাবেই সমস্ত আনন্দের ব্যবস্থা করে রাখে। প্রকৃতির নিজস্ব একটা সারল্য আছে। কিন্তু আমরা কি পারি সেই সব সারল্যকে সাদরে গ্রহণ করতে! ভালবাসতে! স্নেহের আখরে ভরিয়ে দিতে ! প্রকৃতির সহজ, সাবলীল সবকিছুই সমার্থক অপু-দুর্গার সঙ্গে। কিন্তু আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের মাঝে সে সারল্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
বিস্তীর্ণ মাঠ, কাশফুল আর শৈশবের সাক্ষী হয় না। শৈশব থেকে কৈশোর বা যৌবন এগিয়ে যায় নিয়মমাফিক পড়াশোনা,নিয়মানুবর্তিতা আর শৃংখলার হাত ধরে। অপু-দুর্গারা কোথায় যেন হারিয়ে যায় যান্ত্রিকতার ভিড়ে। অনলাইনে মুখ গুঁজে বেড়ে ওঠে শৈশব। উৎসব হয়ে ওঠে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নতুন জামা-কাপড়ের সমাহার। নামী রেস্তোরায় স্পেশল ডিশ। রোজকার রুটিন থেকে নির্দিষ্ট কিছুদিনের ছুটি। তারপরে সব হারিয়ে যায়। আবার বিষন্নতা ঘিরে ধরে মনকে।
কিন্তু উৎসব মানে কি শুধুই কয়েকদিনের জাঁকজমক? উৎসব কি আমাদের ধৈর্য ও সংযম শেখায় না?
আরো সহিষ্ণু হতে শেখায় উৎসব। ভালোর আলোতে মগ্ন হতে শেখায়। আমাদের মনের যা অন্ধকার অলিগলি রয়েছে, সেখানে আলো ছড়িয়ে দিতেই আসে উৎসব। এবছর উৎসবের মেজাজ অন্যরকম। মারীকালে সবকিছুই ভার্চুয়াল। উৎসবের ভিড়ে কারোর আনন্দ যাতে ম্লান না হয়ে যায় তার জন্যেই এ ব্যবস্থা। উৎসবের মধ্যে পরশপাথর খোঁজার মতো স্নিগ্ধতা খুঁজি আমরা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর অপ-দুর্গার সেই স্নিগ্ধতা। কি অপার সারল্যে তারা ছুটে চলেছে ধোঁয়া ওঠা ট্রেনকে লক্ষ্য করে। ওদের কষ্ট হচ্ছে না। ওরে জানে সবশেষে মিলিয়ে যাবে ট্রেনের গতি। ওরা ছুঁতে পারবে না তাকে। অথচ ওই সামান্য দৌড়েই তাদের আনন্দ। খুশির কোন নির্দিষ্ট শর্ত হয় না। তার অবস্থান অন্তরের অন্তঃপুরে। সেই পথ পর্যন্ত পাড়ি দেওয়ার রাস্তা খুঁজে দেয় উৎসব। সেজে ওঠা চারপাশ স্যাটেলাইটের মত মনের গলিঘুঁজিতে আলো ফেলে। খুঁজে নেয় আমাদের মনের ভিতরের সারল্য মাখানো অপু-দুর্গাদের।
উৎসব মানেই একমুঠো আলো। মনের অলিগলিতে নিত্যদিনের বাসা বেঁধে থাকা একঘেয়েমি থেকে মুক্তির আস্বাদ। তাই উৎসব চলে গেলেই মন খারাপ হয় সকলের। প্রতীক্ষায় থাকি আমরা পরেরটার। মেঘ যেমন প্রকৃতির আকাশে ভেসে বেড়ায়, উৎসব সময়ের আকাশে তেমনি ভেসে বেড়ানো ভেলার মত। আমাদের আনন্দের আশ্বাস জাগায়। ভালো থাকার পথে এগিয়ে দেয়। উৎসব মানে মৃন্ময়ী রূপের পুজো নয়। চিন্ময়ী রূপেরও আরাধনা। অপু-দুর্গাদের সঙ্গে নিয়ে হইহই করে আনন্দের পথে এগিয়ে চলা। উৎসব মানেই উদযাপন। যাপনের গ্লানি থেকে বেরিয়ে এসে উদযাপনের আনন্দ উপভোগ করা। তার মধ্যে দিয়ে খুঁজে পাওয়া নিজেকে। তবে এই উদযাপন যেন হয় সকলকে নিয়ে। উদযাপন মানে সকলের আনন্দের সমাহার। এভাবেই উৎসব আমাদের এগিয়ে দেয়। শুধু কয়েক দিন জাঁকজমকপূর্ণ কিছু পালন নয়। বরং প্রকৃতি, সারল্য, আশ্বাস সকল অনুভূতিদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলা। প্রকৃত অর্থে অপু-দুর্গাদের কোন কিছু হারাতে না দেওয়া। রেলগাড়ির মত অনন্তের পথে ছুটে চলতে গিয়ে অন্তরের অপু-দুর্গাদের হারিয়ে না ফেলার শপথ নেওয়াই হোক উৎসবের লক্ষ্য। সেটাই হোক কাম্য।