১৯৬৩ সাল। বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে তখন উত্তম কুমার উজ্জ্বল নক্ষত্র। মহানায়ক। তাঁর ‘উত্তরায়ণ’, ‘সূর্যশিখা’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘দেয়ানেয়া’র মতো অনবদ্য সব ছায়াছবি যখন আপামর দর্শককুলকে আপ্লুত করছে; ঠিক সেই সময়ই ‘পলাতক’ ছবির নায়ক হিসেবে অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটালেন অনুপ কুমার। সকলকে অবাক করে উত্তম কুমারের সেই দীপ্তশিখার মাঝেই আপামর দর্শকের বিপুল ভালোবাসা আদায় করে নিলেন। ‘পলাতক’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল। শুধু তাই নয়, উত্তম কুমারের পাঁচখানা ছবির দুর্ধর্ষ অভিনয়কে টপকে অনুপ এই ছবির জন্য বি.এফ.জে.এ পুরস্কার জয় করে নিলেন বছরের শ্রেষ্ঠ নায়ক হিসেবে। অনেক বড় অভিনেতা না-হলে এটা সম্ভব হত না।
তবে নায়ক চরিত্রে অনুপ কুমারের এই প্রথম আবির্ভাব নয়। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত ‘ধাত্রীদেবতা’ ছবিতে তিনি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিলেন নায়করূপে। এই ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন ছন্দা দেবী।
বাংলা চলচ্চিত্রে অনুপ কুমারের প্রথম আবির্ভাব কিন্তু নায়ক হিসেবে নয়। তিনি চলচ্চিত্রে এসেছিলেন মাত্র চার বছর বয়সে, শিশুশিল্পী হিসেবে। ১৯৩৪ সালে, ‘হালখাতা’ ছবিতে। ছবির জন্য প্রয়োজন ছিল বেশকিছু শিশুশিল্পীর। সেই সময় শিশুশিল্পী-সাপ্লায়ারের এমন রমরমা ছিল না। তাই পরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আত্মীয়-বন্ধু কয়েকজনের ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে দিয়ে এই ছবির অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন। অনুপ কুমারের বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দাস ছিলেন তাঁর বন্ধু। সেই সূত্রেই ‘হালখাতা’ ছবিতে অনুপ কুমারের আবির্ভাব ‘মাষ্টার অনুপ’ হিসেবে। তবে পেশাদার শিল্পী হিসেবে তিনি প্রথম অভিনয় করেন অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সংগ্রাম’ ছবিতে ১৯৪৬ সালে। তখনও তিনি ‘মাষ্টার অনুপ’ নামেই পরিচিত হন।
অনুপের বাবা ধীরেন্দ্রনাথ প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে শিশিরকুমারের থিয়েটার দলে অভিনয়ও করতেন। তবে নায়ক ছাড়া যে-চরিত্রে গানের বহর বেশি, সেই চরিত্রেই অভিনয় করার সুযোগ পেতেন তিনি। এইসব চরিত্রে আবার অভিনয়ের সুযোগ তেমন থাকত না। তাই এসব চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর অভিনয়সত্তা তৃপ্ত হতে পারেনি কখনই। আর এই অতৃপ্তি থেকেই তিনি চাইতেন যে পুত্র অনুপ অভিনয়ে আসুন। তাঁর অতৃপ্ত বাসনা পূরণ করুন। তাই বন্ধু ডি. জি অর্থাৎ পরিচালক ধীরেন্দ্রনাথের এক কথাতেই শিশুপুত্রকে অভিনয় করতে দিতে রাজি হয়ে যান তিনি। শুধু তাই নয়, অনুপ যাতে ভালো অভিনেতা হয়ে উঠতে পারেন তার জন্য ছোটবেলা থেকেই তাঁকে চরিত্রের মধ্যে কীভাবে ঢুকতে হয়, কীভাবে ডায়লগ বলতে হয়, কীভাবে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে হয়—সে-সব শিক্ষা দিয়েছেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন নিজের সঙ্গীতের আসরে, স্টেজ শো-তে; দর্শকের সামনে কীভাবে নিজেকে মেলে ধরতে হয়, সে-সব শেখাতে।
পিতার সাহচর্যে এভাবেই ক্রমে ক্রমে অনুপ হয়ে উঠেছিলেন একজন জাত অভিনেতা। পরবর্তীকালে বহুমুখী অভিনেতা হিসেবে সিনেমা, থিয়েটার ও যাত্রার পৃথক পৃথক অভিনয়ধারায় নিজের ছাপ রেখে অনুপ পিতার স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। সাবলীল, সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক ছিল তাঁর অভিনয়। সেটাই ছিল তাঁর নিজস্ব ঘরানা, তাঁর একান্ত নিজস্ব ও অননুকরণীয় বৈশিষ্ট্য। সে তিনি ‘পলাতক’-এর বিবাগী নায়ক হোন বা ‘আলোর পিপাসা’র পতিতাপল্লির দালাল কিংবা ‘শত্রু’র বজ্জাত পুলিশ অথবা ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ ছবির নায়কের রোমান্টিক বন্ধু—সবেতেই তিনি ছিলেন সমান পারফেক্ট। তিনি একইসঙ্গে দর্শককে হাসাতে পারতেন, কাঁদাতে পারতেন, অসম্ভব ভাললাগায় ভরিয়ে দিতে পারতেন। একজন অসম্ভব শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন অনুপ কুমার।
পর্দা ও পর্দার বাইরে অসাধারণ কমিকসেন্স ছিল তাঁর। একবার ভাবুন ‘বসন্ত বিলাপ’-এর সেই দৃশ্যটির কথা, যেখানে সকলের চোখ এড়িয়ে সুমিত্রার অফিসে তাঁর সঙ্গে প্রেম-সাক্ষাৎ করতে এসে সৌমিত্রকে দেখে সিঁড়ির নীচে লুকিয়ে পড়েন অনুপ। লুকিয়ে পড়েই দেখতে পান, তাঁর স্ট্যান্ড করা সাইকেল নিয়ে পালাচ্ছে চোর। তখন তাঁকে আড়াল ছেড়ে বেরোতেই হয়। কিন্তু চোর ধরতে বেরিয়ে তিনি বন্ধু সৌমিত্র ও পরিচিত ডাক্তার তরুণ কুমারের মুখোমুখি হয়ে যান। তাঁরা সুমিত্রার অফিসের বাইরে অনুপকে দেখে অবাক। এখানে কী ব্যাপারে আসা, জানতে চান। কিন্তু তাঁদের প্রশ্নকে সাবলীল অভিনয়ে পাশ কাটানো, প্রেম করতে এসে ধরা পড়েও ধরা না-পড়তে চাওয়ার যে প্রচেষ্টা, তা এক কথায় অসাধারণ। সমগ্র দৃশ্য জুড়ে স্ল্যাপস্টিক, উইট আর ফানের মিশেল; কিন্তু অভিনয়ে কোথাও বাড়াবাড়ি না-করে কী সাবলীল গতি, কী স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রেখে আমাদের মুগ্ধ করে অনাবিল আনন্দ দিয়েছেন অনুপ! এসব ক্ষেত্রে একটু এদিক-ওদিক হয়ে গেলেই ভাঁড়ামো হয়ে যায়। এই যে ভারসাম্য বজায় রাখা—এটা সকলের আয়ত্তে থাকে না, অনুপের ছিল।
অভিনয়ে ভারসাম্য ছিল বলেই তরুণ মজুমদার ‘পলাতক’ ছবিতে অনুপ কুমারকে নায়ক হিসেবে ভাবতে পেরেছিলেন। অনুপ কুমারকে ভাবার কারণে তিনি বাংলায় কোন প্রযোজক পাননি। ছবি থেকে অনুপকে বাদ দিতে বলায় তিনি বলেছিলেন, অনুপকে বাদ দিয়ে ছবিটাই করবেন না। তাতে যদি চলচ্চিত্রজীবন ছাড়তে হয়, সেও আচ্ছা! পরে যখন বিখ্যাত অবাঙালি পরিচালক-প্রযোজক ভি. শান্তারামের আনুকূল্যে ছবিটি হল, তখন তরুণের আস্থা, বিশ্বাস ও নির্বাচন যে কতটা নির্ভুল ছিল তা প্রমাণ করেছিলেন অনুপ। তরুণের আস্থা ও বিশ্বাসকে বার বার সম্মান জানিয়েছেন অনুপ। তাই তরুণের পরিচালনায় তিনি অনিবার্য হয়ে ওঠেন; ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ঠগিনী’, ‘বালিকা বধূ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’-র মতো ছবির বিচিত্র চরিত্রাবলীর অভিনয়ে এক অনবদ্য মুগ্ধতার ছাপ রেখে যান। তরুণের মতোই আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে আর-এক বিখ্যাত পরিচালক রাজেন তরফদার তাঁর ‘জীবন কাহিনী’ ছবিতে অনুপকে নায়ক হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। বাংলা ছায়াছবির ভিড়ে কী অভিনয়ে, কী বিষয়ে, কী নির্মাণে এ-ছবিও আজ ক্লাসিক।
তরুণ মজুমদার বা রাজেন তরফদারের মতো পরিচালকেরা পরিচিত নক্ষত্র-নায়কের বাইরে তথাকথিত নায়ক নন, এমন অভিনেতাদের নায়কচরিত্রে রেখে বা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রেখে দর্শক রুচি বনাম চলচ্চিত্রের প্রয়োজন—এই নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে চিত্রনির্মাণ করতে পছন্দ করতেন। তাতে তাঁদের ছবি যেমন সার্থক হত, তেমনি বহুমুখী অভিনেতারা নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পেতেন। তবে ধারার বাইরে গিয়ে এই ধরণের চিত্রনির্মাণের ঝুঁকি নিতে সবাই পারেন না। তাই অনুপ কুমারের মতো শক্তিশালী অভিনেতাদের কমিক চরিত্রে বা কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দিনের পর দিন অভিনয় করে যেতে হয়েছে। চিত্রনাট্যও সব সময় তাঁদের সাহায্য করত না। তবে তাঁরা শক্তিশালী বলেই দুর্বল চিত্রনাট্য সত্ত্বেও ভিড়ের মাঝে নিজেদের আলোর বলয়টিকে ঠিক উদ্ভাসিত করে দিতেন। তাঁরাও দর্শককে হলে যাওয়ায় আগ্রহ যোগাতেন। ছবির পোস্টারে নায়ক-নায়িকার পরই পরিবেশক লিখতে বাধ্য হতেন, ‘শ্রেষ্ঠাংশে—অনুপ কুমার’…