প্রোটাগনিস্ট যখন সকলের কাছের সকলের ভালবাসার কিংবা হয়ে উঠেছেন কারো আইডল তখনই তাকে পিছন থেকে ছুরির আঘাতটি হানে অ্যান্টাগনিস্ট। যাকে চলতি ভাষায় বলে ভিলেন। এরা গল্পের নায়ক-নায়িকাকে কিছুতেই সকলের চোখের মণি হতে দিতে চায় না। এই ভিলেনের রূপ ভিন্ন। নানাভাবে তার আগমন ঘটে গল্পে। সে কখনও সরাসরি শত্রুতা করে আবার কখনও মিত্রবেশে লিপ্ত হয় শত্রুতায়। এমন এক চরিত্র ছাড়া ধারাবাহিক এগোয় না। গল্পে ট্যুইস্ট আসে তাদের হাত ধরেই। তাদের সাজপোশাকই বলে দেয় তাদের চরিত্রটি কেমন। কারো কোঁকড়ানো চুল; কারো বা প্ল্যাটিনাম লুক; কারো আবার কপালের টিপেও থাকে বাহার। আর পুরুষ ভিলেন হলে থাকতে পারে চোখে কালো চশমা কিংবা লম্বা মুক্তোর মালা- এমন আরও হরেক রকমের সিম্বল থাকে ধারাবাহিকের অ্যান্টাগনিস্টদের।
ইদানীংকালে এই অ্যান্টাগনিস্টদের ভূমিকা আরও বেড়ে গেছে ধারাবাহিকে। এই চরিত্রের মাধ্যমে তারা হয়ে উঠছে দর্শকের চোখের বিষ। অনেকে আবার তাদের সেই দুষ্টুমিরই ফ্যান হয়ে যান।
সাম্প্রতিককালে এই ভিলেনের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন যারা তাঁরা হলেন চান্দ্রেয়ী ঘোষ, রিমঝিম মিত্র, বাদশা মৈত্র, জয়জিত বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, অঞ্জনা বসু, শ্রীতমা রায়চৌধুরী, অয়ন দেব মৌলিক, শর্বরী মুখোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে।
এহেন ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে অনেকেই টেলিপ্রেমী দর্শকের কাছে অপ্রিয় হয়ে যান। এখানেই সেই শিল্পীর সাফল্য।
অভিনেতা জয়জিত বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেন- "আমার মতে একজন ভিলেনই পারে একটি ধারাবাহিকে মোচড় আনতে। ভিলেন ভাল রূপেও লুকিয়ে থাকতে পারে আবার সরাসরি আঘাতও হানতে পারে। সেটা অবশ্য গল্পের লেখক ঠিক করেন। তবে যেভাবেই সেই ভিলেনের আবির্ভাব ঘটুক না কেন প্রোটাগনিস্টের জীবনটা সে একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আর তাতেই বিনোদনে ডুবে যান দর্শক। তাঁরা তো প্রোটাগনিস্টদের নিজের বাড়ির সদস্য মনে করেন। আর প্রতিনিয়ত তার পিছনে পড়ে থাকা ভিলেনটির মৃত্যু কামনা করেন। এখানেই একজন ভিলেনের সাফল্য।" জয়জিতকে প্রথম ভিলেন চরিত্রে দেখা যায় 'সোনার হরিণ' ধারাবাহিকে। এরপর খেলা, নীড় ভাঙা ঝড়, কুসুম দোলা, ফাগুন বউ, নকশিকাঁথা সহ আরও বহু ধারাবাহিকে তাকে দর্শক পেয়ে আসছেন ভিলেন হিসেবে।
দেবযানী চট্টোপাধ্যায় এর আগে 'জরোয়ার ঝুমকো' ধারাবাহিকে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আর এখন 'ত্রিনয়নী' ধারাবাহিকে প্ল্যাটিনাম লুক নিয়ে দুষ্টুমি করে চলেছেন। উদ্দেশ্য সতীনের ছেলে দৃপ্তকে প্রাণে মেরে ফেলা। তাই নানা রকমের ফন্দি সারাদিন এঁটে চলেছে সে। কিন্তু তার সবথেকে বড় শত্রু ত্রিনয়নী এসে পড়েছে যে! এবার কী ভাবে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করবে সে? সেটা দর্শক দেখছেন ধারাবাহিকের প্রতি পর্বে। এই চরিত্র প্রসঙ্গে তিনি জানান-"এক ঘেয়ে ভাল মানুষের রোলে অভিনয় করতে আর ভাল লাগছে না। স্বাদবদলের প্রয়োজন। আর যেকোনও ধারাবাহিক কিংবা ছবিতেই এই ভিলেনরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই চরিত্রের মধ্যে অনেক শেডস আছে। তাই এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে আমার ভালই লাগে। নিজেকে বেশ অন্যভাবে চেনা যায়। সত্যি কথা বলতে কি আমি যেমনটা নই তেমনভাবে নিজেকে দেখতে দারুণ লাগে। এটা একজন অভিনেতাই বেশি ভাল ভাবে অনুভব করতে পারেন।"
কৃষ্ণকলি ধারাবাহিকে দিশাকে কে না চেনে? আর কে না চটে আছে তার উপর? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে সে। যতবারই শ্যামার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনুক না কেন বারবারই হচ্ছে ফেল। তার আরেক সাগরেদ রুক্মিণী। সে তো শ্যামাকে যথেচ্ছভাবে কাজে লাগিয়ে নিজের মেয়ে রাধারানীকে স্টার বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দিল বড় আর ছোট কর্তা। রুক্মিণীর চরিত্রে অভিনয় করছেন শর্বরী মুখোপাধ্যায়। তিনি নেগেটিভ ও পজিটিভ দুই ধরনের রোলেই সমান সাবলীল। জয়ী ধারাবাহিকেও প্রথমে ভাল মামী ছিলেন না তিনি। পরে অবশ্য তাঁর চরিত্রে অদলবদল ঘটে।
'আমি সিরাজের বেগম' ধারাবাহিকে ঘসেটি বেগম এবং মীর্জাফরের চরিত্রে দেখা গিয়েছিল চান্দ্রেয়ী ঘোষ এবং বাদশা মৈত্রকে। দিব্য মানিয়েছিল দুজনকে। বাদশা মৈত্রকে এর আগে এমন ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেননি দর্শক। ধারাবাহিক শুরু হওয়ার আগে সাংবাদিক সম্মেলনে বাদশা মৈত্র জানান-"যেমন তেমন ভিলেন নয় রীতিমতো ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক ভিলেন! এই চরিত্রে অভিনয় করার মজাই আলাদা। এই চরিত্রটিতে অভিনয় করার জন্য ইতিহাসের পাতা উলটে দেখেছেন তিনি। আর ছিল পরিচালকের নির্দেশানুসরণ।
বধূবরণ, শুভদৃষ্টি, আমলকি, আমি সিরাজের বেগম ধারাবাহিকে একচেটিয়া নেগেটিভ রোলে অভিনয় করেছেন শ্রীতমা রায়চৌধুরী। তিনিও ভালবাসেন নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করতে। মজা পান।
বেশ কয়েক বছর ধরে অয়ন মৌলিক সাহেব সুবেদারের চরিত্রে অভিনয় করে চলেছেন। আর সাহেব বাবু মানেই এক লহমায় বলা যায় সেটা নেগেটিভ চরিত্র। আর এখন তো তিনি 'নেতাজি' ধারাবাহিকে অত্যাচারী ব্রিটিশ পুলিশ রিচার্ডসনের চরিত্রে বাজিমাত করছেন। অয়ন এহেন চরিত্র প্রসঙ্গে একটু উলটো সুর গাইলেন। তিনি জানান- "শুধুই অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক দলে অভিনয় করতে চাই না। কোনও ভাল মানুষের চরিত্রেও অভিনয় করতে চাই আমি। টেলিকর্তারা আমাকে শুধুই সাহেবি চরিত্রে ভাবেন। এখানে আমার একটু আপত্তি আছে। আমার চেহারার জন্য আমি শুধুই সাহেব সুবেদারদের অভিনয় করার সুযোগ পাব আর অন্য কোনও রোল পাব না এটা কী ভাবে হয়?"
অঞ্জনা বসুকেও দিনকয়েক আগে পুরোদস্তুর এক নেগেটিভ চরিত্রে দেখছিলেন দর্শক। 'বিজয়িনী' ধারাবাহিকে এক দাম্ভিক, কুচক্রী নৃত্যশিল্পী সুবর্ণা রায়ের চরিত্রে দেখা যাচ্ছিল তাঁকে। এখন অবশ্য তার চরিত্রটি পুরোপুরি পালটে গেছে। এখন তিনি পজিটিভ। অঞ্জনা বসু এর আগেও নেগেটিভ রোল করেছেন। তবে সংখ্যায় তা খুবই কম। বরং ভাল বউমা কিংবা ভাল শাশুড়ির ইমেজেই তিনি অধিক জনপ্রিয় দর্শকের কাছে। তার মতে নেগেটিভ রোল মানেই খাবারে বিষ মিশিয়ে দেওয়া কিংবা গুলি করে মেরে ফেলা নয়। আরও অনেক রকমভাবে অন্যের ক্ষতি করা যায়। সেটাই বলছে 'বিজয়িনী'র গল্প।
'মুখোশের আড়ালে' ধারাবাহিকে উগ্রপন্থী দলনেতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। একশোভাগ নেগেটিভ রোল। তিনি টাইগার। একের পর এক অন্যায় করে চলত টাইগার। নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করাটাকে খুব চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। কারণ খুব বেশি নেগেটিভ রোলে এর আগে দেখা যায়নি এই অভিনেতাকে।
ওদিকে 'রাধা' ধারাবাহিকের রাধাকে মনে আছে? 'মুখোশের আড়ালে' ধারাবাহিকে তিনি ডা: শাওন। নেগেটিভ রোল। শাওন জানান-"মানুষ শুধু শুধু নেগেটিভ হয়ে যায় না। তার পিছনেও কারণ লুকিয়ে থাকে। শাওনের খারাপ হওয়ার পিছনেও একটা কারণ আছে। এই সব নেগেটিভ রোল গুলোই প্রোটাগনিস্টদের ভাল মানুষ হিসেবে পরিচয় করায়। সুতরাং নেগেটিভ রোল করতে ভালই লাগছে। কিন্তু এর পরে আমি আবার পজিটিভ রোলে ফিরতে চাই। নেগেটিভ ও পজিটিভ দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বললে আমি পজিটিভকেই বেছে নেব।"
'নিশির ডাক' ধারাবাহিকের নিশি অর্থাৎ স্বৈরিতী বন্দ্যোপাধ্যায় একদম অন্যরকম। নিশিডাকের সঙ্গে মানুষের লড়াই এই ধারাবাহিকের উপজীব্য।
একাধিকবার ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে অনিন্দ্য পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বলা ভাল বাংলা ধারাবাহিকে তার নেগেটিভ চরিত্রের সংখ্যাই বেশি।
অনেকদিন পর পর্দায় কামব্যাক করেই নেগেটিভ রোলে বাজিমাত করেছিলেন ডলি বসু। রাশি ধারাবাহিকে তাঁর ভিলেনি ইমেজের ফ্যান হয়েছিলেন অনেকেই।
বাংলা ধারাবাহিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেগেটিভ চরিত্রেই অভিনয় করেছেন এমন তালিকায় আছে আরও অনেকে। মৌমিতা গুপ্ত, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় নেগেটিভ রোলে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছেন।
মোদ্দাকথা হল এই ভিলেনদের ছাড়া লড়াই জমবে কী ভাবে ধারাবাহিকে? তাই গল্পে এদের উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়।