মনে পড়ে ‘বাদুড় বিভীষিকা’ গল্পের সেই ডানা ছড়ানো বাদুড়টার কথা?
কালো রেখার আঁচড়ে ধারালো একটা বাদুড়। ডানার ভাঁজে ভাঁজে গল্পের নাম।
স্মরণ করুন ‘বাদশাহি আংটি’র প্রচ্ছদ। বিস্ফারিত দৃষ্টি আর উর্দু হরফের মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে হারিয়ে যাওয়া মুঘল আংটি!
‘বাদুড় বিভীষিকা’, ‘বাদশাহি আংটি’ সত্যজিৎ রায়ের সেরা সৃষ্টির অন্যতম। এই তথ্য আজ আর কাউকে বলে দিতে হয় না।
কিন্তু বায়োস্কোপের সত্যজিৎকে নিয়ে যেভাবে আলোচনা হয় আর্টিস্ট সত্যজিৎ বা ইলাস্ট্রেটর সত্যজিৎ ততটাই আড়ালে। জীবনের শুরু থেকেই তিনি চেয়েছিলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হতে। সেই ভেবেই শান্তিনিকেতন যাওয়া। নন্দলাল বসুর ছাত্র।
আড়াই বছরের মাথায় যখন কলাভবন ছাড়লেন তখন নন্দলাল বসুকে বলে এসেছিলেন পুরদস্তুর কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হবার ভাবনা। হৃদয়ে রেমব্রান্ট আর ভিঞ্চি। চোখ জুড়ে চিনা ল্যান্ডস্কেপ, জাপানি কাঠখোদাই আর ভারতীয় মিনিয়েচারকলা।
গল্প লেখার সঙ্গে সঙ্গে ইলাস্ট্রেশনের কাজ তিনি নিজেই করতেন। সত্যজিতের গল্পের হেডপিস মানে শীর্ষ চিত্র- শিরোনাম চিত্র বাংলায় অলঙ্করণের ধারাকে বদলে দিয়েছিল। এই ক্ষেত্রেও তিনি এক ফেনোমেনন।
‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’। গল্পে ঢুকবার আগেই চোখ টেনে নেয় ফেলুদা তোপসের এক্সপ্রেশন। পাঠক আন্দাজ করতে পারে পাতায় পাতায় কী আকর্ষণ অপেক্ষা করে আছে। রেখার সঙ্গে কালো রঙের ব্যবহার, লামা নৃত্য, এক সিকিমি’র জপযন্ত্রে সত্যজিৎ রায়ের সই। গল্পে রহস্যের সঙ্গে পাহাড়ী ছোঁয়া!
সারা জীবন প্রায় হাজার খানেক গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতার হেডপিস ইলাস্ট্রেশনের কাজ করেছেন। সংখ্যাটা তার বেশিও হতে পারে। প্রফেসর শঙ্কু সিরিজ। ফেলুদা সিরিজ। তারিনীখুড়ো ও অন্যান্য গল্প এবং বিভিন্ন লেখকদের গল্প কবিতার অলংকরণ।
ক্যালিগ্রাফি। টাইপোগ্রাফি। পিকটোগ্রাফি। এই তিনের মিশেল ঘটাতেন।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৪১-এ। তখন কলাভবনের ছাত্র। অমৃতবাজার পত্রিকায় রবিবাসরীয়’র পাতায় প্রকাশিত হল সত্যজিৎ-এর প্রথম ছোটগল্প। অ্যাবস্ট্রাকশন।দু’বার গল্প প্রকাশের পর রাতারাতি ভ্যানিশ!
ফিরে এলেন ১৯ বছর বাদে। ইলাসট্রেটর সত্যজিৎ হয়ে। সেই সঙ্গে পাঠকের দরবারে আবার ফিরল সন্দেশ। পারিবারিক পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।
নিজের লেখার সঙ্গে নিজের ছবি। সন্দেশের পাতায় একে একে টেরোজাকাটিলের ডিম, সেপ্টোপাসের খিদে, সদানন্দের খুদে জগৎ, অনাথ বাবার ভয়- এর মত জনপ্রিয় গল্প সব।
গল্প পড়ার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যেত ‘দেখা’র আনন্দেও। লেখায়-রেখায় জ্যান্ত সিনেমা। হেডারে আটকে থেকেও তার চলন থামানো অসম্ভব! এক্সপ্রেশন, ডিটেলিং, গতি- এক ঝলকে ঝাপটে আসে উত্তেজনা!
‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ গল্পে ছুটন্ত ট্রেন আর চলন্ত ঘোড়ায় স্ট্যান্টম্যানের অ্যাকশন। কে বলে ছবি স্থির!
রহস্য জানতেন সত্যজিৎ। গল্পের মুড ধরা থাকত হেডপিসে।
১৯৮৩ পর্যন্ত একটানা চলেছিল অলংকরনের কাজ।
১৯৮৪ তে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে অন্য শিল্পীকে দায়িত্ব দিতে বাধ্য হন। সেই সময়ের ফেলুদা সিরিজের অলংকরণ করেন সমীর সরকার। ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’, ‘ভূ-স্বর্গ ভয়ংকর’, ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ গল্পের অলঙ্করণ করেন। কিন্তু শকুন্তলার কণ্ঠহারে ফেলুদা’র ডানহাতে ঘড়ি দেখে ভয়ানক হতাশ হলেন সত্যজিৎ। ঠিক করলেন যত কষ্টই হোক নিজের গল্পের ছবি নিজেই করবেন।
১৯৯০ পর্যন্ত সেভাবেই। অসুস্থ শরীর বড় বাধা। তার ছাপ অলংকরণেও। অনেকক্ষেত্রে সেই চেনা ক্যালিগ্রাফির বদলে স্ট্রেট টাইপ ব্যবহার হয়েছে কাহিনীতে।
নিজের লেখা শেষ ফেলুদা উপন্যাসের অলংকরণ দেখে যেতে পারেননি। দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়কে। ১৯৯৫ সালে ফেলুদা সিরিজের ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’ প্রকাশিত হয় ধারাবাহিকভাবে। এছাড়া বেশ কয়েকটি অন্য উপন্যাস। সেগুলির অলংকরন করেন সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় ও অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়।