উপেক্ষার আরও এক ভাষা আন্দোলন
আবেগের ভাষা বাংলা ভাষা।তার অস্তিত্বের জন্যে লড়েছিল মানভূম।
হাওড়া ব্রিজ লোকারণ্য। হেঁটে চলেছে মানুষের মিছিল। সত্যাগ্রহ। ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। ভাষার স্বাধীনতার দাবীতে।
বাংলার মানভূম। আজকের পুরুলিয়া। হিন্দি ভাষাভাষীদের দাপট থেকে নিজেদের ভাষার শৃঙ্খল মুক্তি চেয়েছিল তাঁরা।
আন্দোলনের বারুদ জমতে শুরু করে সেই ’৪৭ এ। দেশ স্বাধীন হল। ভাষার ভিত্তিতে ভাগ হল এক দেশ। বাংলার পুরুলিয়ায় এসে মিশল হিন্দি সংস্কৃতি। তখন মানভূম।
বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুধুমাত্র ২১ এই সীমাবদ্ধ নেই। কালের ধারায় ভালবাসার ভাষা দিয়েছে বহু স্বীকৃতির অগ্নিপরীক্ষা।
হিন্দির এই আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা আরও কয়েক দশক আগে থেকেই। স্বাধীনতা কাঙ্খিত। স্বাধীনতা অধিকার। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সে অর্থে কতটা ফলদায়ক হয়েছে? প্রশ্ন আজও ফিরে ফিরে আসে।
বিদেশী সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা! এই যদি উদ্যেশ্য হয়ে থাকে তবে এর ফল যোগাতে বেগ পেতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষদের।
দেশ ভাগের পর তোরজোড় শুরু হয় ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের। আঁচ এসে লাগে বাংলার মানভূমে।স্থানীয় জাতীয় কংগ্রেস শাখার উপর।
১৪ জুন, ১৯৪৮। কংগ্রেস ভেঙে গঠিত হয় ‘লোকসেবক সংঘ’।বিবাদের কারণ ভাব প্রকাশের ভাষা। এর আগে বান্দোয়ানের জিতান গ্রামে হয়ে গিয়েছিল জেলা কংগ্রসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন।
দীর্ঘ আলোচনায় সিদ্ধান্ত, ‘মানভূম বাংলা ভাষাভাষী’।
শুরু হল অগ্রাহ্যের পালা। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটির সায় না থাকায় গান্ধীবাদী বহু নেতৃত্ব পদত্যাগ করলেন।’৪৬ এ পাশ হল বিহার নিরাপত্তা আইন । কালা কানুন। অত্যাচার জুটল ভাষা আন্দোলনকারীদের কপালে।
জাতির জনক মহাত্মা। তাঁর দেখানো পথেই সত্যাগ্রহ। তবুও নেমে এল রাষ্ট্রের পীড়ন।গ্রেফতার হলেন সাত নেতা। জুবিলি ময়দান, রাসমেলা ময়দানের সভাতেও লাঠি চালায় পুলিশ।
সাঁতুড়ির জনসভায় পুলিশের লাঠির আঘাতে মাথা ফাটে চিত্তভূষণ দাশগুপ্তের। মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করা হয় বহু নেতাকে।
আন্দোলনের হাওয়া আর সীমানা মানে না। খবর ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা থেকে দিল্লী। সকল স্তরের বাঙালি সরব হন ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বে।
সত্যাগ্রহের পাশাপাশি ঝড় তুলেছিল একটি পত্রিকা। টুসু গানে মানভূম। স্থানীয় লোকগান টুসু। সেই সুরেও মেশে বিদ্রোহের ভাষা।শুরু হল টুসু সত্যাগ্রহ।
সঙ্ঘবদ্ধতার আরেক শিল্প মাধ্যম এই টুসু।আবালবৃদ্ধবনিতা একসঙ্গে এক সুরে, এক ছন্দ্ নাচে - গানে মিলিত হয়ে আবেগের ভাষা আন্দোলনে সামিল হতে থাকেন।
পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের তৎকালীন দুই মুখ্যমন্ত্রীর তরফে বঙ্গ-বিহার যুক্ত প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব আসে। এ বার আর মানভূম নয়। প্রতিবাদে নামে খোদ কলকাতা।
১৪৪ ধারা জারি করে ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সাবেক মানভূমের নানা স্থানে চলেছে বিহার পুলিশের অত্যাচার। ঝালদা ও জয়পুরে দোকান লুঠ হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর।
সীমিত আন্দোলন ইতিহাসে নাম তোলার পথে পা বাড়ালো। বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণের প্রতিবাদে ১০ জন মহিলা-সহ ১০০৫ জনের সত্যাগ্রহী দল পাকবিড়রা থেকে পদযাত্রা শুরু করে কলকাতার রাজপথের উদ্দেশে।
২০ এপ্রিল থেকে ৬ মে। টানা ২১ দিন প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন সত্যাগ্রহীরা। কণ্ঠে ছিল ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি আর ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে’ গান। কলকাতায় পৌঁছলে
৭ মে ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে ১৪৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয় ৯৫৬ জনকে। থামেনি অভিযান। ভাষার অঙ্গীকার মর্যাদা পেল শেষমেশ।
পাশ হল বঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন । অপেক্ষার আরও প্রহর কাটিয়ে এল ১ নভেম্বর, ১৯৫৬। জন্ম নিল অযোধ্যা ঘেরা আজকের পুরুলিয়া।
ভাষা জন্ম দিল নতুন এক জেলার। সময়ের নিরিখে পৃথিবীর ইতিহাসে চলা এই ভাষা আন্দোলন দীর্ঘতম। প্রায় এক দশকরে ভাঙ্গা গড়ার লড়াইয়ে ভাষা উড়িয়েছিল বিজয়পতাকা।
একে একে বিস্মৃতির জালে জড়িয়ে অন্যান্য গুটিকতক আন্দোলনের মত এই আন্দোলনের ইতিহাসও পুরনো ফ্রেম বন্দি হয়েছে।মাতৃভাষার জন্য এই ত্যাগ মনে রাখেনি বর্তমান।
মনে রাখেনি ভজহরি মাহাতো-র লেখা সেই রোম খাঁড়া করা গান, -
শুন বিহারী ভাই/তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই/তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি/বাংলা ভাষায় দিলি ছাই ৷