ইতিহাস কি ঐতিহাসিককে মনে রাখবার কোনো দায় নেয় না? আসলে আমরা বাস করছি এমন একটা সময়ের মধ্যে, যেখানে কোনো কিছুই সংরক্ষণ করে রাখার দায় অনুভব করিনা আমরা কেউই। তাই বোধহয়, প্রাচীন ইতিহাসকে জনমানসের সামনে তুলে ধরা ইতিহাসবিদ আজ কালের অতলে হারিয়ে যেতে বসেছেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের খ্যাতি মূলত ইতিহাসবিদ হিসেবেই। ২৩টি বড় ও ৫৫টি ছোট প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষেরর সঙ্গে ১৯২২ সালে বিখ্যাত মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা আবিষ্কার করেছিলেন তিনিই। ঐতিহাসিক উপন্যাসের রচয়িতা হিসাবেও তাঁর বেশ পরিচিতি ও কদর রয়েছে। ময়ূখ, শশাঙ্ক, ধর্মপাল, প্রভৃতি ইতিহাসধর্মী উপন্যাস এককালে পাঠক মহলে বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের ভূমিপুত্র রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও অন্যান্য পরিচয়ও রয়েছে, যা চর্চার অভাবে আজ হারিয়ে গিয়েছে।
বহরমপুর শহরের রাধিকামোহন সেন রোডের ওপর বিশাল দোতলা বাড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের। ১৮৮৫–র ১২ এপ্রিল সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাখালদাস। বাবা মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী। ১৯০০–তে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল থেকে ‘এন্ট্রান্স’ পাস করার পর ১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে এফএ পাস করেন। তখনই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজে যুক্ত হন। এরপর ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের সহকারী সুপার হিসেবে যোগ দেন। কর্মসূত্রেই সিন্ধু প্রদেশে যান এবং নদীর জরিপ শুরু করেন। তারপরই আবিষ্কার করেন বিভিন্ন নগরের ধ্বংসাবশেষ সহ বিখ্যাত প্রাচীন সভ্যতার। প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরে কাজ করার সময়ে সেখানকার সংগৃহীত অসংখ্য মূর্তি ও ভাস্কর্যের সংগ্রহ থেকে তিনি প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে তাঁকে প্ররোচিত করেন জাদুঘরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যক্ষ ড. থিয়োডোর ব্লখ। তাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি শুধু ভারতীয় জাদুঘরই নয়, অন্য সংগ্রহশালারও মূর্তি ও ভাস্কর্যের নিদর্শন সমূহ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফলই প্রতিফলিত হয়েছে শিল্পকলা বিষয়ক তাঁর বিভিন্ন লেখায়।
রাখালদাসের শিল্পকলা বিষয়ক বেশকিছু মূল্যবান লেখা আজ বিলুপ্তির প্রহর গুনছে। শিল্পকলা বিষয়ক লেখালিখিতে রাখালদাসের প্রধান কৃতিত্ত্ব এই যে, তিনি একটি নতুন শিল্প-ঘরানাকে বিশেষজ্ঞ মহলে পরিচিত করান ও সেই শিল্প স্বীকৃত হয়। এই শিল্প-ঘরানাটি হলো ‘গৌড়ীয় শিল্প-ঘরানা’। তাঁর এই প্রিয় শিল্প নিয়ে প্রবাসী পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ লেখেন রাখালদাস। গৌড়ীয় শিল্পের ইতিহাস (মাঘ ১৩৩৪), গৌড়ীয় শিল্পের আদিযুগ (বৈশাখ ১৩৩৫), দশম শতকে গৌড়ীয় শিল্প (আষাঢ় ১৩৩৫), গৌড়ীয় শিল্পের পুনরুত্থান (অগ্রহায়ণ ১৩৩৬), গৌড়ীয় শিল্পে দাক্ষিণাত্য প্রভাব (বৈশাখ ১৩৩৭) এরকমই কয়েকটি প্রবন্ধ। বৈদগ্ধে উজ্জ্বল, বিশ্লেষণে নতুন দিশা দেখানো প্রবন্ধগুলি প্রকাশ কালেই বিশিষ্টজনেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিল্প বিষয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের পাশাপাশি তাঁর মেধা, বৈদগ্ধ ও পাণ্ডিত্যের পূর্ণ প্রকাশ দেখা যায় শিল্প-সমালোচনা বিষয়ক তাঁর একমাত্র বই 'Eastern Indian School of Mediaeval Sculpture' বইতে। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এই বই প্রকাশ করে 'Archeological Survey of India'.
ইতিহাস, শিল্প-সমালোচনার বাইরেও রয়েছেন আরো একজন রাখালদাস, যিনি নাট্যসমালোচনাতেও আপন প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন। ঐতিহাসিক নাটকের চরিত্রদের বেশভূষা বা মঞ্চসজ্জা নিয়েও রাখালদাস লিখেছেন জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ। বিচ্যুতি নিয়ে কলম ধরেছেন বহু ক্ষেত্রে। 'ঐতিহাসিক' পরিচয় ছাড়া তাঁর এই সমস্ত পরিচয় আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে।
একদিন ইতিহাস খুঁড়ে প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরে বহু অজানা কে জানিয়েছিলেন যিনি, সেই গুণী মানুষ টিই আজ এ প্রজন্মের কাছে 'বিলুপ্ত ইতিহাস'। ১২ এপ্রিল তাঁর ১৩৫ তম জন্মদিন।