প্রতিবাদের বঙ্গভাষায় অন্নদাশঙ্কর রায়

ছড়াকে শিশুতোষ হতেই হবে, এ-ধারণা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন সুকুমার রায়; আর তাকে বিস্তার দিয়েছিলেন আর-এক 'রায়', তিনি অন্নদাশঙ্কর। সেই বিস্তারের জন্যই ছড়া তার বক্তব্য ও প্রকাশভঙ্গি - 

'দোল দোল দুলুনি, 

রাঙা মাথায় চিরুনি'-তে নিজেকে সীমাবদ্ধ না-রেখে, 'তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো

তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো

তার বেলা?'-য় এসে ধামাধারীদের দিকে নির্ভীক প্রশ্ন তুলে প্রবাদ হয়ে উঠেছে।


শুধুমাত্র ছড়াকার হিসেবেই যে বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হওয়া যায়, এ-নজির যেমন যোগীন্দ্রনাথ সরকার তৈরি করেছেন, সুকুমার রায় তৈরি করেছেন, তেমনি তৈরি করেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়ও।


Annadashankar1

 

অন্নদাশঙ্কর শুধুই যে ছড়া লিখেছেন এমনটাও নয়, দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে অসংখ্য মননশীল প্রবন্ধ লিখেছেন, অজস্র প্রথাভাঙা মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখেছেন, গল্প-কবিতা লিখেছেন, ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন, ভাষা-সংস্কারের কাজে লিপ্ত হয়েছেন; কিন্তু আশৈশব আমাদের প্রাণের মানুষ হয়েছেন তিনি ওই ছড়ার মাধ্যমেই।

তবে বাল্যকালে তিনি কোনওদিন ছড়াকার হবেন বলে ভাবেননি, গল্পকার হবেন বলে ভাবেননি, সংসারী হবেন বলেও ভাবেননি। শুধু ভেবেছিলেন যে, সাংবাদিক হবেন। এমন সাংবাদিক, যাঁর কলম হবে নির্ভীক, হবে অসির মতো ক্ষুরধার। সেই কলমের নিব হবে এমন সংস্কারমুখী, যা সমাজের সমস্ত অসাম্য ঘুচিয়ে দেবে। 

সাম্য-অসাম্য-সাংবাদিকতা-পরোক্ষে এই সব ভাবনা মাথায় ঢোকানোর মধ্যমণি ছিলেন বাবা। তিনিই ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সংবাদপত্র, তাঁকে করে তুলেছিলেন নিয়ত ও নিয়মিত পাঠক। আজন্ম ছেলেকে তাই-ই করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি।

ওড়িশার ঢেঙ্কানলে অন্নদাশঙ্করের জন্ম। কলকাতা থেকে বাড়িতে বাংলা সংবাদপত্রের সঙ্গে আসত গুচ্ছের বাংলা সাময়িকপত্রও। তার মধ্যে প্রমথ চৌধুরীর 'সবুজপত্র' হয়ে উঠেছিল তাঁর অসম্ভব প্রিয়। লিখনে তার কথ্যভাষার বাহার অচিরেই তাঁর প্রাণের সামগ্রী হয়ে উঠেছিল। সে-ভাষা যেন তাঁকে অহরহ বলত: লেখো, লেখো, লেখো...

সেই আহ্বানেই মনের মধ্যে একদিন লেখার বাসনা ঢুকল। মন বলল, লিখব, লিখব, লিখব...লিখতে যদি হয়, তাহলে 'সবুজপত্র'র ভাষাতেই লিখব।

Annadashankar2

বাল্য থেকেই তিনি বাংলা, ইংরেজি আর ওড়িয়া - তিন ভাষাতেই হয়ে উঠেছিলেন সমান চোস্ত। চারিপাশে বন্ধুবর্গের মধ্যে ওড়িয়া সাহিত্যের চর্চা, কাজেই সেই চর্চার তিনিও হলেন অংশীদার। শুধু অংশীদার হয়েই রইলেন না, 'সবুজপত্র'র আদর্শে ওড়িয়া ভাষায় রীতিমতো শুরু করলেন সাহিত্য আন্দোলন। বৈকুণ্ঠনাথ পট্টনায়ক, হরিহর মহাপাত্র, শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহী - নতুন আঙ্গিকে সাহিত্য-সাধনার স্বপ্ন দেখা এই চার বন্ধুকে নিয়ে তৈরি করলেন 'সবুজ দল'। 

 

সে এক প্রবল তারুণ্যের ক্ষণ। সকলেই বিপুল প্রাণশক্তিতে চঞ্চল। নতুন কিছু করার তাগিদেই সেই চঞ্চলতা। কাজেই অবিলম্বে প্রকাশিত হল নতুন ভাবনায়, নতুন ভঙ্গিতে লেখা ওড়িয়া কবিতার সংকলন, 'সবুজ কবিতা'। 

 

অন্নদাশঙ্কর-সহ দলের সকলের কবিতা স্থান পেয়েছিল এই সংকলনে। নতুনত্বের এই আন্দোলন যে যথেষ্ট ফলপ্রসূ এবং সুদূর প্রসারী হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। কেননা, সাহিত্যের ঐতিহাসিকরা এই পর্বকে ওড়িয়া সাহিত্যের 'সবুজ যুগ' বলে চিহ্নিত করেছেন। আর তার উদ্গাতা হয়ে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন অন্নদাশঙ্কর। 

 

ওই আন্দোলন ও উদ্দীপনার পরেও ওড়িয়া সাহিত্য-জগৎ থেকে অন্নদাশঙ্কর সরে এলেন, স্নাতক হওয়ার পর। এর কারণ আর কিছু না। ওড়িশা থেকে বাংলায় আসা এবং বাংলা সাহিত্যকে আশৈশব ভালোবাসা। বাংলায় অবশ্য লেখা শুরু হয়ে গেছে এই ছাড়াছাড়ির বহু আগেই। 

 

স্কুলে একবার তলস্তয়ের 'টোয়েন্টি থ্রি টেলস' নামের একটি বই পুরস্কার পেয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর। তারই একখানা গল্প এত ভালো লেগে গিয়েছিল যে, একদিন 'সবুজপত্র'র আদর্শে কথ্যভাষায় সটান অনুবাদ করে ফেললেন। 

 

Annadashankar3

কাজটা শেষ করে বার কতক নিজেই পড়লেন। মন ও কান বলল একই কথা। অনুবাদে কোন জড়তা নেই, বরং বেশ যুৎসই হয়েছে। ফলে আর ফেলে না-রেখে পাঠিয়ে দিলেন 'প্রবাসী'-তে। এও তাঁর ভালোলাগার একটি কাগজ। সেই ভালোবাসার জায়গা থেকে কয়েকমাস যেতে-না-যেতেই শুভ সংবাদটি পত্রযোগে হাজির হল এবং লেখাটি প্রকাশিত হল। এটিই বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা

 

অনুবাদ গল্প তো হল। উপন্যাসে লেখায় মতি হল তার কিছু পরেই। ছোট্ট একটি ঘটনা আছে তার অনুষঙ্গেও। সেটি হল, পাটনা কলেজে পড়ার সময় ইংরেজিতে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রবন্ধ লিখলেন। প্রথম হলেন। পুরস্কার পেলেন রোঁম্যা রোলার চার খণ্ডের উপন্যাস, 'জাঁ ক্রিস্তফ'। 

 

উপন্যাসটি পড়লেন। পড়ে তাঁর মনে যে অভিঘাত তৈরি হল, তাতে মহাকাব্যিক উপন্যাস রচনার প্রতি তাঁর অমোঘ আকর্ষণ তৈরি হল। পরবর্তীকালে তাঁর লেখা ছ'খণ্ডের 'সত্যাসত্য' ও চার খণ্ডের 'ক্রান্তদর্শী'র মতো পুব-পশ্চিম মেলানো ছকভাঙা উপন্যাস সেই অভিঘাতেরই জারিত ফসল।

 

শুধু বিদেশি সাহিত্যিক বা সাহিত্য নয়, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি অন্নদাশঙ্করকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। রবীন্দ্ররচনা তাঁকে কখনও মুক্তি দিয়েছে, কখনও আলোড়িত করেছে, কখনও দিয়েছে অনন্য আলোকের সন্ধান। রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' নাটক একদিন তাঁকে এই তিনস্তরেই নাড়া দিল। ফলে, নাড়া খেয়ে লিখে ফেললেন একটি প্রবন্ধ, 'রক্তকরবী-র তিনজন'। বন্ধুর তাড়নায় পাঠিয়ে দিলেন "বিচিত্রা" পত্রিকায়।



কিছুকালের মধ্যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত তো হলই, সেই সঙ্গে সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে এল আরও লেখা পাঠাবার আবদার। সেই অবদারেই অন্নদাশঙ্কর হাত দিলেন সদ্য ইওরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ধারাবাহিক রচনায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পথে বিপথে'র অনুকরণে নিজের লেখার নাম দিলেন, 'পথেপ্রবাসে'। 



"বিচিত্রা'য় প্রকাশিত হতে শুরু করল, 'পথেপ্রবাসে'। সুললিত ভাষায় অপূর্ব সরস বর্ণনা পাঠকের মন জয় করে নিল কয়েক কিস্তিতেই। অচিরেই লেখাটি প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথের নজরে পড়ল। অবিলম্বেই তাঁদের অকুণ্ঠ প্রশংসায় ধন্য হলেন অন্নদাশঙ্কর। এবং, এই এক রচনার মাধ্যমেই তিনি লেখক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠলেন।



অন্নদাশঙ্কর বিখ্যাত সাহিত্যিক হয়েও তাঁর বাল্যের সাংবাদিক হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায় যে ব্রত রেখেছিলেন, সেই ব্রত কখনোই ভুলে যাননি। তাই যেখানেই দেখেছেন শাসক ও প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রকে হত্যা করতে উদ্যত, সেখানেই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। সেই প্রতিবাদ কখনো শানিত হয়েছে স্বনামে লিখিত ছড়ায়, কখনো বা 'লীলাময় রায়' ছদ্মনামে লেখা প্রবন্ধমালায়। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে কেরলে রাষ্ট্রপতি শাসন নিয়ে লিখেছেন 'চন্দ্রগ্রহণ', চিন-ভারত সীমান্ত সমস্যা নিয়ে লিখেছেন 'যোগভ্রষ্ট', ঢাকার দাঙ্গা নিয়ে লিখেছেন 'নক্ষত্রের আলো', আসাম-বাংলা সম্পর্ক অবনতির প্রেক্ষাপটে লিখেছেন 'ড্রাগনের দাঁত'। 



অন্নদাশঙ্কর জানতেন সাহিত্যিক সমাজ বদল করতে না-পারলেও সমাজ-বদলের স্বপ্ন বুনতে পারেন মানুষের মনে, প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে না-পারলেও তার চোখে চোখ রাখার স্পৰ্ধা দেখাতে পারেন, প্রবল বিরোধী কণ্ঠ হয়ে উঠতে পারেন সাধারণের স্বপক্ষে। অন্নদাশঙ্কর এই ভাবনাতেই আজীবন সাহিত্য-যাপন করেছেন, তাই তার ছাপও রয়েছে তাঁর ছড়া ও প্রবন্ধ সাহিত্যে। এরই জন্য তাঁর প্রতিবাদী-ঋজু বিশ্লেষণমুখী প্রবন্ধ সাহিত্য আজও মননশীল মানুষের আশ্রয়, আর তাঁর ছড়া আপামরের সম্পদ...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...