প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তাঁকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছিল। কিন্তু তাঁর নেশা তাঁকে বানিয়ে দিল জীবন্ত কিংবদন্তি।
টি-স্কেল ধরা হাতটাও হয়ত বাইশ গজে বল ঘুরাবে বলে অপেক্ষা করছিল। দুরন্ত ঘুর্ণি ওই লেগেছে পাক, এ দুনিয়া ঘরে বন বন বন! হ্যাঁ, তিনিই ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বল ঘোরানো হাতের মালিক। উচ্চতায় তিনি আমাদের ফেলুদা বা অমিতাভ বচ্চনের মতোই দীর্ঘকায়।
নানান ভূমিকায় তিনি সমৃদ্ধ করেছেন ভারতীয় ক্রিকেটকে, কখনও বল হাতে মাঠের লড়াই লড়েছেন, অধিনায়ককে এনে দিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত ব্রেক থ্রু, নিজে নেতৃত্বও দিয়েছেন দলকে! আবার কখনও মাইক হাতে করেছেন ক্ষুরধার বিশ্লেষণ, দিয়েছেন স্বকীয় সাবলীল ধারাভাষ্য, আবার দ্রোণাচার্য হয়ে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ। আমাদের দেশে ক্রিকেট একটা ধর্ম। এগারো জন ভগবান আর ১৩৫ কোটি ভক্তের ২২ গজের মন্দির। বিশ্বের তাবড় তাবড় স্পিনারদের জন্ম দিয়েছে এশিয়া মহাদেশ। ভারতীয় উপমহাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়, এই মহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সর্বকালের সেরা স্পিনার হলেন অনিল কুম্বলে।
১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর টেস্ট ক্রিকেট জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর ১৮ বছর ভারতীয় বোলিং-এর দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। ভাঙা চোয়াল নিয়েও করে গিয়েছেন বল, দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়তেন। ওই একই বছর, ১৯৯০ সালেই শুরু হয়েছিল কুম্বলের একদিবসীয় ক্রিকেটারের জীবন। ডেবিউ-এর পর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে, জীবনের সেরা বিশ্বকাপ খেলেছিলেন ৯৬-তে! ৯৬ -এর বিশ্বকাপ; ভারতীয় টিমে তাঁকে অপরিহার্য করে তুলেছিল। সে সময় তাঁকে ছাড়া প্রথম একাদশ ভাবাই যেত না।
কেবল স্পিনার নয়, ভারতের সর্বকালের সেরা বোলার তিনি। একটু তথ্য-পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তা নজরে আসে। টেস্ট ক্রিকেটীয় জীবনে ৬১৯ টি শিকার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। যা ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং বিশ্বে আজও চতুর্থ স্থানে রয়েগিয়েছেন কুম্বলে। জীবনে পঁয়ত্রিশবার এক ইনিংসে ৫ টি করে উইকেট নিয়েছেন। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০ টি করে শিকার করেছেন আট বার! কেবল শিকারই নয়, তিনি নজির গড়েছেন বোল্ড করার সংখ্যাতেও। যা ভারতীয়দের মধ্যে সর্বাধিক, এবং বিশ্বে দ্বিতীয়। তাঁর গোটা টেস্ট ক্রিকেটীয় জীবনে, তিনটে স্ট্যাম্প আর দুটো বেল লক্ষ্য করে ৪০,৮৫০ বার বল ছুঁড়েছেন কুম্বলে।
কেবল বোলার হিসেবেই নয়, ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসাবেও তিনি ছিলেন শ্বাশত। শুধু ধীর গতির টেস্টই নয়, খেলেছেন টি-টোয়েন্টিও! আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরেও ছুটিয়ে খেলেছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার কোচ হিসেবেও কাজ করেছেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার বেঙ্গালুরু এবং মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের সঙ্গে।এসব ছাড়াও বিশ্ব ক্রিকেটে কুম্বলে বিখ্যাত হয়ে আছেন, এক অনন্য দৃষ্টান্তের জন্য, সেও এক আশ্চর্য ঘটনা। বিশ্ব ক্রিকেট কেবল দুবারই এমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। সে যেন ইতিহাসের এক সমাপতন।
১৯৫৬-এর ৭ই ফেব্রুয়ারী, ইংল্যান্ডের অফস্পিনার জিম ল্যাকার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে এক ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন। ঠিক তার সাড়ে চার দশক পরে, ওই একই দিনে অর্থাৎ ৭ই ফেব্রুয়ারী কুম্বলের কাকতালীয়ভাবে একই ঘটনা ঘটান। যা ভারতীয় ক্রিকেটের এক স্মরণীয় ক্ষণ। এক ইনিংসে চিরপ্রতিপক্ষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১০ উইকেট নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন কুম্বলে। রাজধানী দিল্লিতেই হয়েছিল কুম্বলে ভূমিকম্প। ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ সাল, দিনটিতেই দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় এক ইনিংসে ১০ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন অনিল কুম্বলে।
স্পিনার হয়েও বিশ্ব ক্রিকেটের ত্রাসের নাম কুম্বলে। মন্থরগতির ঘূর্ণিতেই কিস্তিমাত করতেন তিনি, আজ হয়ত বিশ্বের বহু ব্যাটসম্যানের দু:স্বপ্নে তিনি আসেন। সম্প্রতি আইসিসি, ভারতের এই কিংবদন্তি লেগ স্পিনারকে আইসিসির হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেই অন্তর্ভুক্তি উপলক্ষে, আইসিসি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিল কুম্বলেকে সন্মান জানাতে। যেখানে স্টিফেন ফ্লেমিং, ওয়াসিম আক্রম থেকে শুরু করে কুমার সাঙ্গাকারার মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটারেরা কুম্বলের খেলোয়াড় জীবন নিয়ে স্মৃতি চারণা করেছেন।
অনিল কুম্বলের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা জানান, ‘কুম্বলের কারণে আমি একজন ব্যাটসম্যান হিসাবে অনেকগুলো রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। তিনি একজন প্রচলিত লেগ-স্পিনার ছিলেন না। খুব বড়, লম্বা গ্যাংলি বোলার হাই আর্ম অ্যাকশন নিয়ে দৌড়াতেন এবং বোলিং করতেন। ফাস্ট বোলিং করতেন, সোজা বোলিং করতেন এবং সঠিকভাবে বোলিং করতেন। তাঁর বোলিং-এর বিরুদ্দে রান বের করাটা সহজ ছিলনা। অনেক বাউন্স হতো ... বলের উপর তার দুর্দান্ত গতি থাকত এবং যদি পিচে কোনও রুক্ষতা থাকত তবে ব্যাটসম্যানের পালিয়ে যাওয়ার খুব কম সম্ভাবনা থাকত। খুব ভাল মানুষ, খুব ভাল ক্রিকেটার, ভারত এবং বিশ্ব ক্রিকেটে একজন আসল চ্যাম্পিয়ন।’
আইসিসির ওই ভিডিওতেই ওয়াসিম আক্রম কুম্বলে সম্পর্কে বলেন, 'অনিল কুম্বলে বাকি লেগ স্পিনারদের থেকে একদম আলাদা ছিলেন।' মাহেলা জয়াবর্ধনের মতে, ‘তোমায় জানতে হবে যে অনিল কুম্বলে সব সময় তোমার জন্য কিছুনা কিছু পরিকল্পনা করছেন।’ প্রতিপক্ষকে শুধু তুখোড় ঘূর্ণি দিয়েই চিন্তায় ফেলতে বোধ করি কুম্বলেই পারতেন। সতীর্থরা তাঁকে জাম্বো বলে ডাকত, আমরা ভারতীয় ক্রিকেট অনুরাগীরা ভাগ্যবান কারণ, আমরাই একমাত্র বলতে পারি আমাদের একটা কুম্বলে ছিল। শুভ জন্মদিন জাম্বো।