আজ ঘুম ভাঙতেই দেখি সকালের মুখ ভার। ধোঁয়া ধোঁয়া চারপাশ। বিছানার পাশেই খোলা জানলাটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জানলার বাইরে হলুদ গাঙ-ফড়িঙের ঝাঁক। গাছে গাছে কেউ যেন সবুজ জলরঙের শিশি উপুড় করে দিয়ে গিয়েছে। অদ্ভুত শান্ত নিঝুম এক সকাল। ইস্পাত সাদা আকাশ। কয়েকটা চোরা রোদের ফালি। তার গায়ে কালো মেঘ জড়িয়ে আছে আদর হয়ে। ঠাণ্ডা হাওয়া বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে মুখ। সে হাওয়ায় কামিনীর গন্ধ। বাগানের গাছের তলা এখন ঝরা ফুলের পাপড়িতে ঢাকা। ঘনিয়ে আসা ছায়ার মাঝে আলো হয়ে জ্বলছে কলকে ফুলগুলো ।
ঘরে আমার অন্ধকার জমে উঠছে একটু একটু করে। পরিযায়ী শীতলতা ভরে দিচ্ছে এলোমেলো শূন্যতা গুলোকে।
কাল মাঝরাতে নিশি ডাকের টানে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হাঁসের বুকের মত সাদা জ্যোৎস্নায় চাঁদ ভাসছে। গুঁড়ো গুঁড়ো রুপোর মায়া। সেই আলোয় ছাদের কোণে জমে থাকা শ্যাওলার দাগ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। তখনও মনে হয়নি এমন মেঘাড়ম্বর সকাল অপেক্ষা করে আছে কয়েক ঘণ্টা পরেই...
আমার চোখের সামনে বারবার পালটে যাচ্ছে আকাশ। এ খেলা চলবে সারাদিন। নিঝুম আকাশে মন খারাপ জমে উঠছে ক্রমশ। তার সঙ্গে খাপছাড়া এক মন কেমন। আবহাওয়ায় ‘ডিপ্রেশন’। জলভরা মেঘে ভর করে ঘনিয়ে ওঠে ঝিমঝিম ভাব। কিছুই লাগে না। জটপড়া ভাবনায় ধোঁয়া-ধোয়া ভাব। কোথায় সাদা, কোথায় কালো, এ কেবল ধূসরের বাড়াবাড়ি।
কিন্তু আমার কোন ডিপ্রেশন নেই। বিষাদ খোঁজার মত মন কেমন নেই, আমার কেবল সঙ্গী মনখারাপ। প্রতিদিনের খুব চেনা শহরটার মাথায় মেঘে মেঘে যখন ছায়া নামে তখন তারা সব ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠে। মন খারাপের পিছুটানে পুরনো চিঠির ডাক পিওন। এসে দাঁড়ায় দরজায়।
কোথাও যেন একটা মিড় ভুল হয়ে গেছে। অথচ, তার অস্তিত্ব আমি স্বীকার করছি না।পালাছি...পালাচ্ছি। ভুল থেকে ভুলে। আর একটা ভুলে।
আচমকা দেখি ভুলগুলো সব নদী হয়ে বইতে শুরু করল। যে নদী টা সব জানে। দমকা হাওয়া। বেগে বৃষ্টি আসে। বড় বড় ফোঁটায়...
ছোটবেলায় যখন সাঁতার শিখতাম, এভাবেই পুকুরের জলে বৃষ্টি ফোঁটারা ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমি তখন সবে শরীর ভাসাতে শিখেছি। বাড়ির পাশে শান বাধানো বড় পুকুর। প্রতি বর্ষায় কানায় কানায় ভরে উঠত। সিঁড়ির পাড় থেকে অনেকটা দূরে সাঁতার দিয়ে পার হয়ে যেতে পারতাম। জলে ভেসে থাকতে থাকতে পুকুরের তলায় লুকানো প্রাসাদ থেকে এক্ষুণি জলপরীরা উঠে আসবে আমার কাছে। তাদের নীল চোখ। ঝিনুক আর মুক্তোর দানায় সাজানো। কিন্তু কোনদিন আসত না তারা। যেন তাদের বদলি হিসাবেই বৃষ্টি আসত।, মুক্তোর মত ঝরে পড়ত বৃষ্টির ফোঁটারা। আর মন খারাপ লাগত না আমার। এভাবে অনেকটা দূর... গোটা গায়ে- মাথায় কুচি কুচি সবুজ পানা লেগে যেত। মাথায় অঝোর বরষা। আমার বয়েজ কাট চুল তার অনেক আগেই ভিজে লেপটে গিয়েছে মাথায়।
ঠিক সিনেমার মত। কাট টু ফ্ল্যাশব্যাক।
যেখান থেকে রাস্তাগুলো আর ফিরে আসে না কোনদিনও। চোখের সামনে বর্তমানের বৃষ্টি দখল করে নিয়েছে সব কিছু। এ আমার একলা আষাঢ়। অন্তরে বাহিরে অঝোর ধারায় ঝরছে। ঝরে পড়ছে। দিশাহীন।আর দিস্তে দিস্তে মন কেমন।
মন খারাপের গায়ে কুয়াশা লেগে থাকে। এ কুয়াশা বর্ষাকালের।তবু আমার কাছে কুয়াশা মানে দার্জিলিং।মেঘ মাখা ঘুম পাহাড়।পাহাড়ের গায়ে চাঁদমালার মত সারি সারি কাঠ বাড়ি।জানলা খুললেই যেখানে ঘরের মধ্যে শিমুল তুলোর মত মেঘ বয়ে যায়।পাশেই ম্যাল।পাথরের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি শেষ দুপুরে।রাস্তার হাল্কা মেঘ কুয়াশা হঠাৎ রঙ বদলাতে শুরু করল। সাদা মেঘের গায়ে পেন্সিলের শিসের মত কালো আঁচড়গুলো স্পষ্ট ততক্ষণে। ঠাণ্ডা পাহাড়ি হাওয়া। এমন সময় ভিজে কুয়াশার চাদর ঠেলে বৃষ্টি এল। এম্নিতেই রাস্তার ওপর ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ গা ভিজিয়ে দেয়।বৃষ্টির জন্য তাই আলাদা মেঘ নেই। তখনও টাইগার হিল কে একটা জায়েন্ট সাইজ আইসক্রিম ভাবার বয়স পেরিয়ে আসিনি।হোটেল থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে একা ম্যালে।
ঠিক য তখনই বাঁধ ভাঙল তিস্তার মেঘ।লাল সোয়েটার, বউটুপি আর হাঁটু ছোঁয়া মোজায় টুপটুপ বৃষ্টিতে চুবচুবে হওয়ার সাক্ষী প্রায় নির্জন ম্যাল আর তার দু চারটে বেয়াড়া ঘোড়া।
তবে সে বৃষ্টির ঘোর কেটেছিল আচমকাই! গালের ওপর নেমে আসা রামথাপ্পড়ে।হাজার বার ঠোঁট কামড়েও বাঁধ মানেনি চোখের জল।
সম্বৎসরের এই আষাঢ়ে কি যে আছে!
বারবার সে দিক ভুলিয়ে দিতে চায়। যে পথে আর ফেরা হবে না সেই পথেই টেনে নিয়ে যেতে চায় জোর করে। যেখানে হয়ত আর ফিরতে চাই না তেমন করে কোনওদিন...
কাশী বোস লেনের সেই গলিটায় ফিরে যাই। একটানা আষাঢ়ে নর্দমা উপচে ভাসিয়ে দেয় ্পায়ে চলার পথ, নর্দমার পাশে পলি জমে বড় বড় ঘাস আর নীল জংলা ফুল মাথা তুলছে। লাল ইট ঢাকা এবড়ো খেবড়ো সরু রাস্তা। তার পাশেই বারো ঘর এক উঠোন, মাঝে একখানা রুমালের মতো চৌকো আকাশের ছিল সে জীবন।দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘর। সে ঘরের একমাত্র বড় জানলাটায় মরচে ধরা লোহার গারদ। পড়তি গরমে দেখতে পেতাম গরাদের গা বেয়ে মুখে সাদা ডিম নিয়ে পিঁপড়ের সারি চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বর্ষা আসার খবর ওরা আগেই পেয়ে যায়, বাতাস বদলে যাওয়ার গন্ধে। রোদ- বৃষ্টি-জলে ধুয়ে গেছে জানলার সবুজ রঙ।তবু সেখান থেকেই পৃথিবী দেখা যেত বেশ। সকাল থেকে বিকালের রোদের রঙ বদল। এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুতে সরে যাওয়া। শীত- গ্রীষ্ম-বর্ষা। শিমুল-কৃষ্ণচুড়ার উচ্ছ্বাস। শেষ বসন্তে নিমফুলের নেশায় কেমন করে মাতাল হয় দুর্গা টুনটুনি, শালিখের দল। জানলার ওপারে সেই বড় পুকুর। তার বুকের ওপর কালো মেঘ নেমে এলে এসে জুটত ফড়িং। ডানায় সোনালি রোদ। তাদের লাফালাফি যত বাড়ত মেঘ তত ঘন হয়ে জল ছুটে নেমে আসত। লম্বা শ্বাস নিলেই সোঁদা গন্ধ টের পাওয়া যেত।জলের হাওয়ায় বর্মা শাকের লতারা ঝিরঝিরিয়ে দুলে উঠত।কচু পাতা থেকে ঝরে পড়ে জমে থাকা হিরের কুচি।
এদিকে বানভাসি অন্দর। আলমারির মাথায় বাথটাব আর দরজার মুখে পরিত্রাণের বালতি। বিছানা-বালিশ পলিথিন শিটের আড়ালে রাখঢাক খুঁজছে।
সজাগ রাতের মাঝে দেখার চেষ্টা জল কত বাড়ল।স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ উঠে আসে নোনা ইট থেকে। ঘুণধরা বরগায় বিপন্ন চড়ুই...বহু যুগের ওপার থেকে ডাক দিয়ে যায় সেই রংচটা ভাঙ্গা জানলাটা। সেখানেই রাখা ছিল আমার শৈশব...কৈশোর...
আজ খুব ভোরে হঠাৎ সস্তার রেনকোটের তলায় নীল সাদা স্কুল ইউনিফর্মে একটা ছোট মেয়ের সঙ্গে দেখা, জমা জল ডিঙাতে না পেরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বোধ হয়। তার দিকে হাত বাড়াতেই সে আমার আঙ্গুল ছুঁলো।
আঙ্গুল ছোঁয়া টানেই সকাল এলোমেলো। ইংলিশ গ্লাস উইন্ডের পাশে সময় কখন যেন থমকে গেছে।যত্নের বাগানে কি যেন খুজতে চাইছি...পাচ্ছি না।
ডায়রির সুতো আলগা হয়ে পাতাগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে সারা ঘরে।দালানে।বারান্দায়।
ভেসে যাচ্ছি।জলের টানে।ডুবে গেছি মেঘের শব্দে।জল থইথই চারপাশ।নীল বেগুনি লাল নৌকা ভাসছে। আর জানলার পাশে বসে আছে সেই মেয়ে...সেও কি যেন খুঁজছে...
...পাচ্ছে না...