কালী কথা: হ্যামিল্টনগঞ্জ কালী মন্দির

আজকের কালীকথায় সুদূর চা বাগানে পাড়ি দেওয়ার পালা। আলিপুরদুয়ার জেলা তথা ডুয়ার্সের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী কালী মন্দির হল হ্যামিল্টনগঞ্জ কালী মন্দির। ১৯১৬ সালে ইংরেজ সাহেব হ্যামিল্টনের উৎসাহে এই কালীপুজো শুরু হয়। যদিও অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, ১৯১৭ নাগাদ ইউরোপীয় সাহেবদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এই পুজো ও মন্দির। কার্তিকের দীপান্বিতা অমাবস্যায় পুজো উপলক্ষ্যে হ্যামিল্টনগঞ্জ কালী বাড়ির মাঠে বসে বিশাল মেলা। যদিও মেলা বসা শুরু হয়েছে বেশ কিছু বছর পর থেকে। পুজোর বয়স প্রায় ১০৮ বছর, মেলার বয়স নব্বই।

কালীপুজোর দিনেই শুরু হয় মেলা। ইংরেজ আমলে হ্যামিল্টনগঞ্জের কালীপুজোর মেলায় মোরগ লড়াইয়ের আসর বসত। তাতে বাজি রাখতেন শ্রমিকরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা লুপ্ত। মোরগ লড়াই আর হয় না। এখন বারো দিন ধরে মেলা চলে। জেলার পাশাপাশি ভিন জেলা এমনকি ভুটান থেকেও মানুষ আসেন, ভিড় করেন মন্দিরে। পুজো দেন।

পরাধীন ভারতে কালচিনির ডিমা, চিনচুলা, কালচিনি ও রায়মাটাং ইত্যাদি চা-বাগানগুলো ছিল সাহেবদের অধীনে ছিল। ঝাড়খণ্ড থেকে আদিবাসী চা-শ্রমিকদের নিয়ে এসে চা-বাগানের কাজে নিযুক্ত করেছিল ইংরেজরা। ঝাড়খণ্ডের শ্রমিকদের আবদার মেনে কালীপুজোর প্রচলন করেছিলেন ইংরেজ সাহেব হ্যামিল্টন। তাই ঝাড়খণ্ড থেকে প্রতিমা ও পুরোহিত এখানে পুজো করা হত এককালে। চা বাগানের শ্রমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য বাকসা টি কোম্পানির অনুকূল্যেই চালু্ পুজো শুরু হয়েছিল। তদানিন্তন সময়ে বাকসা টি কোম্পানির অন্যতম কর্তা ছিলেন হ্যামিল্টন সাহেব। পরবর্তীতে তাঁর নামেই হ্যামিল্টনগঞ্জ ও হ্যামিল্টনগঞ্জ স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে। হ্যামিল্টন সাহেবের হাতে ধরেই শুরু হয়েছিল কালীপুজো, তাই মন্দিরের নাম হ্যামিল্টনগঞ্জ কালীবাড়ি। কালী পুজো ছাড়াও হ্যামিল্টনগঞ্জে কালীবাড়ি পুজো কমিটি রথযাত্রারও আয়োজন করে প্রতি বছর আষাঢ় মাসে।

হ্যামিল্টনগঞ্জের এই কালীপুজোয় পাঁঠাবলির পাশাপাশি মোরগ বলির রেওয়াজ ছিল। বলিদানের সেই মাংস রান্না হত। এখন যদিও বলি হয় না। ইংরেজরা মাটির প্রতিমা এনে কালীপুজোর সূচনা করেছিল। ঝাড়খণ্ড থেকে পুরোহিত এসে পুজো করত। এখন যদিও স্থানীয় পুরোহিতই পুজো করেন। চা-বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য ছোটনাগপুর, রাঁচি এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকেরা আসত। এলাকায় মনোরঞ্জন কোনও বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। তাই পুজোর পাশাপাশি চালু হয় মেলা। কাঠের মন্দির ও মাটির প্রতিমা স্থাপন করেছিল সাহেবের দল। সেই মন্দিরেই পুজো হত। পরে চা-শ্রমিক ও স্থানীয় মানুষেরা নিজেদের উদ্যোগে পাকা মন্দির গড়েন। ২০০২ সালে মন্দিরে পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজস্থানের জয়পুর থেকে ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে কালো কষ্টিপাথরের মূর্তি বানিয়ে আনা হয়েছে। এখন সেই মূর্তিই পূজিতা হচ্ছে। ফি বছর পুজো দেখতে মানুষ ভিড় জমান। হ্যামিল্টনগঞ্জের কালীপুজোর মেলায় ভিড় জমায় গোটা ডুয়ার্সের মানুষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...