রোজা লুক্সেমবার্গ: এক অনির্বাণ আলোকশিখা

"One is not born, but rather becomes a woman"- বলেছিলেন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ সিমোন দ্য বোভোয়ার। পুরুষ জন্মসূত্রে পুরুষ কিন্তু নারীকে নারী করে তোলে তার পারিপার্শ্বিক, সমাজকাঠামো। প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিক ও বিজ্ঞানী পাইথাগোরাস বলেছিলেন, "There is a good principle that created order, light and man and a bad principle that created chaos, darkness and woman." পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এই ধারণাকে প্রতিহত করে সিমোন প্রশ্ন তুলেছিলেন," What is woman?" সিমোনের মতে মেয়েরা সব সময়েই 'other'. “Thus humanity is male and man defines woman not herself but as relative to him". প্রাচীন গ্রীস ও রোমেও মেয়েরা সমাজে সম্মানের অধিকারী ছিলেন না। স্পার্টা কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগে নারীর শিক্ষার অধিকার ছিল। কিন্তু তীক্ষ্ণধী, মেধাবী যে নারী যুক্তিজালে প্রজ্ঞাবান ঋষিকে কোণঠাসা করতে পারে তাকে সমাজ কোনওভাবেই মেনে নিত না। গার্গীকে যেমন যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন,  “আর কোনও প্রশ্ন নয়। আর প্রশ্ন করলে তোমার মাথা খসে পড়ে যাবে।”  

মনে পড়তে পারে খনার কথা। ‘খনার বচন’  বলে পরিচিত দু/ চার ছত্রগুলিতে ধরা আছে প্রজ্ঞাবতী নারীর প্রখর মননের পরিচয়। অথচ এই খনার কাছে তর্কে পরাজিত হয়ে তাঁর স্বামী ও শ্বশুর তাঁর জিভ কেটে নিয়েছিল। নারীর কাছে পরাজিত পুরুষের এই নিষ্ঠুর আচরণ অবশ্যই নিন্দার্হ। পাশাপাশি সেই সময়ে নারীশিক্ষা কত উন্নত ছিল যাতে এমন তর্ক সম্ভব সে কথাও ভাবতে হবে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন শিক্ষার এই ধারা থেকে ধীরে ধীরে নারীদের সরিয়ে আনা হল। তাদের স্থান নির্ধারিত করা হল গৃহকোণে। তার মন, তার শরীর- কোনও কিছুর ওপরই আর তার অধিকার রইল না। নারীর ওপর থেকে অন্তরালের আবরণ সরাতে অপেক্ষা করতে হল উনিশ শতক পর্যন্ত।

 

Rosa1

 

পাশ্চাত্যে নারীর অধিকারের লড়াইতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল নারীর ভোটাধিকার। ১৮৬৬ সালে জন স্টুয়ার্ট মিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে মেয়েদের অধিকার রক্ষার লড়াইতে সোচ্চার হন। ১৮৯৮ সালেও এমন ধারণা ছিল যে রাজনৈতিক ভাবে সমানাধিকার না পেলেও মেয়েদের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে তাই তাদের ভোটাধিকারের কোনও প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের এই সময়ের এক সদস্যের মন্তব্য তুলে ধরেছিলেন সিমোন, যেখানে বলা হয়েছিল- "it is an indisputable fact that meat goes bad when touched by menstruating women". সমাজে নারীদের স্থান কী ছিল তা এই বক্তব্য থেকেই অনুমান করা যায়। এসব সত্ত্বেও ১৮৮১তে আইল অফ ম্যান-এ, ১৮৯৩- তে নিউজিল্যান্ড উপনিবেশে ( আমেরিকা), ১৮৯৪-তে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া উপনিবেশে ও আরও কিছু অঞ্চলে মেয়েরা প্রথম ভোট দেবার অধিকার পেয়েছিল। ইউরোপে মেয়েরা প্রথম ভোটাধিকার পেল রুশ অধিকৃত ফিনল্যান্ডে, ১৯০৭ সালে। ১৯১৩ সালে নরওয়েতে। এরপর কানাডায়, আমেরিকায়। কিন্তু তখনও অন্ধকারে ইওরোপের অন্যান্য দেশ।

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের সেলাই কারখানার নারীশ্রমিকেরা তাদের অধিকারের দাবিতে পথে নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাদের নানাবিধ দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল- ন্যায্য মজুরি, কাজের সময় নির্দিষ্ট করা এবং কর্মস্থলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের পরিবর্তন। মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি তো পেতেনই এমনকি তাদের জন্য বিদ্যুতের খরচ, দেরি করে কাজের জায়গায় আসা এবং টয়লেটে বেশিক্ষণ থাকার অজুহাতে টাকা কেটে নেওয়া হত। এই অবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে মেয়েরা পথে নামলে পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়। এর বহু পরে, ১৯০৮ সালের এই দিনে নারী শ্রমিকেরা আবার পথে নেমেছিলেন। সেবারের অন্যতম দাবি ছিল নারীর ভোটাধিকার। এই আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে প্রথম জাতীয় নারী দিবস পালন করা হল। ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সম্মেলনেও গুরুত্ব পেল নারীদিবস।

ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলে দেখা যাবে ১৬৭৩ সালেই ফ্রান্সের পলেইন ডি লা ব্যারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন, “পুরুষ নারী সম্পর্কে যা যা বলে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কেননা, সেসব ক্ষেত্রে পুরুষ একই সঙ্গে অভিযুক্ত ও বিচারকের আসনে বসে থাকে।” এই সময়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্গারেট ব্রেন্ট মেরিল্যান্ডের অ্যাসেমব্লিতে উপস্থিত থাকতে চাইলে তাঁর প্রতি জারি হল নিষেধাজ্ঞা। প্রতিবাদ জানালেন পলেইন ডি লা ব্যারে। লিখলেন, " .. Equality of the two sexes, speech physical and moral where it is seen the importance to demolish itself prejudice". ১৭৮৯-তে ফরাসী বিপ্লব। নারীর অধিকার রক্ষার লড়াইতে এই বিপ্লবও তেমন কোনও বিশেষ দিকনির্দেশ করতে পারেনি।

 

Rosa2

 

তবে এই বিপ্লবের একটা সামগ্রিক প্রভাব তো ছিলই। ফরাসি নাট্যকার অলিম্প দ্য গগস্ মেয়েদের জাগিয়ে তোলার জন্য, তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে আহ্বান করলে তাঁর ফাঁসির আদেশ হল। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও গগস্ প্রশ্ন তুললেন- “নারীর যদি ফাঁসিকাঠে ঝোলার অধিকার থাকে তাহলে তার পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন?”  নারীর অধিকার আদায়ের লড়াইতে আর এক ব্যক্তিত্ব মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট-যিনি তাঁর লেখায় জানিয়েছিলেন, নারী কোনও ভোগ্য বস্তু নয়। তার সত্ত্বা আছে, তার বোধ আছে,তার স্বাধিকারের প্রয়োজন আছে। আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপ ও নারী অধিকার আদায়ের লড়াইতে শরিক হয়েছিলেন অনেকেই। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ফরাসী দেশ ব্যতিক্রম হলেও নেপোলিয়নের সময় সে দেশেও ঘনিয়ে আসে অন্ধকার।

১৮২৬ সালে সে দেশে বিবাহবিচ্ছেদ আইন রদ করা হল। ১৮৮৪ সালের আগে সেই আইন আর চালু হল না। মেয়েরা পরিবারের জন্যই তৈরি, অন্য কোনও কাজের যোগ্য নয় তারা- এমনই বলা হত। অগাস্ত কোঁৎ যেমন নারীদের জন্য গৃহকোণের জীবন নির্ধারিত করেছিলেন। বালজাঁক তো স্পষ্ট বলেছিলেন, "পুরুষের মনকে দোলা দেওয়াই মেয়েদের নির্বন্ধ। আর সেখানেই তাদের গৌরব।........ নারী পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তি, পুরুষের পাশে সে নিতান্ত তুচ্ছ"। এই উক্তি মনে করিয়ে দেয় "পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা"-র কথা।

ইতিহাসের ধারা বেয়েই নারী অধিকার রক্ষার লড়াইতে সামনের সারিতে এসে দাঁড়ালেন ক্লারা জেটকিন আর রোজা লুক্সেমবার্গ। সোচ্চার হলেন মেয়েদের ভোটাধিকার বিষয়ে। একটি নির্দিষ্ট দিনকে 'নারী দিবস' বলে পালন করার দাবিও তুললেন। ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইটজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে মিছিল বার করে 'নারীদিবস' পালন করা হল। ১৯১৩ সালে নারীদিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হল ৮- ই মার্চ দিনটিকে। জাতিসংঘ অবশ্য ১৯৭৫ সালের আগে এই দিনটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। নারীমুক্তি আন্দোলনে ক্লারা জেটকিন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তুলনায় আড়ালে থেকে গিয়েছেন রোজা লুক্সেমবার্গ- এক আশ্চর্য আলোকশিখা।

১৮৭১ সালে পোল্যান্ডের দক্ষিণ পূর্বের জামেস্কো শহরে এক ইহুদি পরিবারে জন্ম রোজালিয়া লুক্সেমবার্গের। সেকালে ইহুদি ছেলেমেয়েদের বনেদী স্কুলে ভর্তি হওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু রাশিয়ান জানা রোজা সে কাজ অনায়াসে করেছিলেন।স্কুলের পড়াশোনায় তিনি এতটাই ভালো ছিলেন যে শেষ পরীক্ষার ফলে তাঁর স্বর্ণপদক পাবার কথা ছিল।

কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ হয়। মাত্র ১৫ বছর বয়েসে রোজা নিষিদ্ধ বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দিয়ে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। পোল্যান্ড থেকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন সুইটজারল্যান্ডের জুরিখে। ছোট থেকেই শারীরিক সমস্যা ছিল রোজার নিত্যসঙ্গী। হিপ জয়েন্টের সমস্যায় যে কিশোরীকে দীর্ঘদিন শুয়ে থাকতে হয়েছিল, শারীরিক কারণে যাঁকে বিশেষ ধরণের জুতো ব্যবহার করতে হত সেই নারী কতটা অসমসাহসী হলে গুপ্তদলে যোগ দিয়ে দেশত্যাগ করার ক্ষমতা রাখেন তা সহজেই অনুমেয়। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রোজা আইন, অর্থনীতি ও দর্শন নিয়ে পড়ার পর, ডক্টরেট-ও করেছিলেন। সুইটজারল্যান্ডে থাকাকালীন তাঁর লেনিন, প্লেখানভ এবং লিও জয়েসের সঙ্গে পরিচয় হয়।

এরপর তিনি চলে যান জার্মানিতে। সেখানে যুক্ত হন ‘জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি’র সঙ্গে। ১৯০৪ সালে রোজা জার্মান সম্রাটের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মত প্রকাশ করায় কারারুদ্ধ হলেন। ১৯০৫ সালে জারের শাসনাধীন রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূত্রপাত হলে রোজা গোপনে পোল্যান্ড চলে গিয়ে রুশ বিপ্লবের সমর্থনে কাজ শুরু করলেন। পোল্যান্ডের পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করল। আবার জেল। রোজা ছিলেন প্রবলভাবে যুদ্ধবিরোধী। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রোজা এবং কার্ল লিয়েবনেক্ট যুদ্ধের বিরোধিতা করেন। যুদ্ধ সমর্থন করায় জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিও তিনি ত্যাগ করলেন।

পার্টিতে থাকার সময়েও রোজা বারবার মেয়েদের সমস্যা তুলে ধরেছিলেন। নিপীড়িত নারীকে তিনি শোষিত জনগণের অংশ বলেই মনে করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথেই নারীমুক্তি সম্ভব। ‘প্রলেতারিয়েত নারী’  প্রবন্ধে রোজা বলেছিলেন, "নারীরা সমস্ত কাজে পুরুষের সমান অংশ নেয়, পুরুষের মতো অর্থনৈতিক কাজে অংশ নেয়, একই ভাবে পুঁজির জন্য দাসত্ব করে, রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে। সব শেষে এই সব কাজ তাকে রক্তহীন করে তোলে, সে দমিত হয়।" রোজা স্পষ্টভাষায় মনে করিয়ে দিয়েছেন "স্বৈরাচার ও নারীর সীমিত অধিকার ধনতান্ত্রিক শাসক দলের দুটি হাতিয়ার।" রোজা ছিলেন নারীর ভোটাধিকারের পক্ষে- "Women's suffrage is the goal". তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, "A hundred years ago, the Frenchman Charles Fourier, one of the first great people of socialist ideals wrote these memorable words: In any society, the degree of female emancipation is the natural measure of the general emancipation". ভোটাধিকার নারীর রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে বলে রোজা বিশ্বাস করতেন। তাই তাঁর মত ছিল- "......the proletarian woman's lack of political rights is a vile injustice, and the more so far being by now atleast half a lie. After all, masses of women take an active part in political life". মেয়েদের জাগিয়ে তোলার জন্য একের পর এক প্রবন্ধ লিখেছেন রোজা, করেছেন লাগাতার সংগ্রাম। তাঁর লেখা 'ভোটাধিকার ও শ্রেণীসংগ্রাম' প্রবন্ধটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, "Those who do not move, do not notice their chains".

রোজা লুক্সেমবার্গের বৈশিষ্ট্য এখানেই যে তিনি যেমন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দলের অভ্যন্তরে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার যথার্থ প্রতিফলনের জন্য লড়াই করেছেন তেমনই নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। সর্বতোভাবে ব্যতিক্রমী এই যুক্তিবাদী নারী সম্পর্কে জর্জ অ্যাডলার বলেছিলেন, "There she was: a girl, a Jew, a cripple- possessed of an electrifying intelligence, a defensively arrogant tongue and an unaccountable passion for social justice." 'সোশ্যাল জাস্টিস'-র দিক দিয়েই রোজা নারীদের সমস্যাকে ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি ছিলেন যেমন তাত্ত্বিক তেমনই কর্মী। ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের শুরুর দিকে জার্মানিতে নারীশ্রমিকদের আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিল। নারীর ভোটাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকটের বিরোধীতা, যুদ্ধ বিরোধীতাসহ আরও নানান দাবিতে নারীশ্রমিকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শ্রমিকশ্রেণীর নারীদের সামাজিক শক্তি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন রোজা। তিনি তো এইটিই চেয়েছিলেন। সব সমস্যা সরিয়ে মেয়েরা এগিয়ে আসুক, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করুক, নিজেদের দাবি আদায় করে নিক- এমনই ছিল রোজার চাওয়া। শুধু গৃহকোণ, শুধু বদ্ধ জীবন নারীর জন্য নির্ধারিত হতে পারে না। এ যেন মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন- "যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম?" "প্রলেতারিয়েত নারী" প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, "সম্পত্তির অধিকারী বুর্জোয়া নারীর জন্য তার ঘরটাই তার পৃথিবী। প্রলেতারীয় নারীর জন্য সমগ্র পৃথিবী, তার দুঃখ আর আনন্দ নিয়ে, তার ঠান্ডা নিষ্ঠুরতা এবং নগ্ন আকার নিয়ে তার ঘর।"

জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি ত্যাগ করে রোজা, লিয়েবনেকট, ক্লারা জেটকিন সহ আরও কয়েকজন মিলে 'স্পার্টাকাস লিগ' গড়ে তুললেন। ১৯১৬ থেকে ১৯১৮’র ১৮ নভেম্বর রোজার আবার কারাদন্ড হল। কিন্তু রোজার শরীরকে কারারুদ্ধ করা যায়, মনকে নয়। জেল থেকে লেখা একাধিক চিঠিতে ধরা রইল তাঁর আগুনঝরা বক্তব্য। লিখলেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। ছাড়া পেলেন ১৯১৮’র  নভেম্বরের ৮ তারিখে। জেল থেকে বেরিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার লড়াইতে। শুরু করলেন 'ডাই রোট ফাইনে' নামে একটি পত্রিকা। সরকারবিরোধী একাধিক মিছিলে অংশগ্রহণ, একাধিক জনসভায় বক্তব্য বলা ছিল তাঁর এই সময়ের কাজ। শেষ ভাষণ দিলেন রোজা ১৯১৯’র ১৫ জানুয়ারি। তারপর অগ্নিশিখা নির্বাপিত  হল। দক্ষিণপন্থী মিলিশিয়া বাহিনী ফ্রেইকর্পসের আততায়ীরা তাঁর মাথায় গুলি করে হত্যা করার পর দেহ খালে ফেলে দিয়েছিল। শীতের কারণে দেহ বিকৃত না হওয়ায় পরে তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।

রোজার জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এসেছে তাঁর মৃত্যু। চির সংগ্রামীর এমন মৃত্যুই সাজে। একদিকে সমাজতন্ত্র, অন্যদিকে গণতন্ত্র- এই দুটিকে তিনি মেলাতে চেয়েছিলেন। চলতি পথের পথিক হতে চাননি রোজা। তাই কী প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলে, কী নারীবাদী আলোচনায় তাঁকে এতকাল একটু আড়ালে রাখা হয়েছে। ক্লারা জেটকিন রোজার সম্বন্ধে বলেছিলেন, "She gave herself completely to the cause of Socialism, not only in her whole life, daily and hourly, through struggles of many years- She was sharp sword, the living flame of revolution"

রোজা লুক্সেমবার্গ সম্পর্কে সশ্রদ্ধ ছিলেন সিমোন দ্য বোভোয়ারও। তিনি বলেছিলেন, রোজা লুক্সেমবার্গ ও মারি কুরি "brilliantly demonstrate that it is not women's inferiority that has determined their historical insignificance: it is then historical insignificance that has doomed them to inferiority". বলেছিলেন লেনিন, বলেছিলেন আজ থেকে একশোরও বেশি বছর আগে যে রোজা লুক্সেমবার্গের রচনাবলী প্রকাশ করা উচিত কেননা আগামীদিনের পাঠকদের কাছে তা হবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। লেনিনের সঙ্গে রোজার মতপার্থক্য ছিল, ছিল না পারষ্পরিক শ্রদ্ধার অভাব। রোজার মৃত্যুর পর তিনি বলতে দ্বিধা করেননি যে, "Rosa Luxemburg was mistaken...., She was mistaken....., she was mistaken.... But inspired of her mistakes she was and remains for us- an eagle."

আজকের দুনিয়ায় রোজা লুক্সেমবার্গকে নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে। তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করার পালা শুরু হয়েছে। বার্লিনে তাঁর ছবি হাতে নিয়ে, বুকে নিয়ে অগণিত নারীর মিছিল হয়েছে। তবু সব চাওয়া পূর্ণ হয়নি। আজও যুদ্ধ হচ্ছে, আজও নারী 'অর্ধেক আকাশ' হয়ে উঠতে পারে নি। অনেক পথ হাঁটতে হবে, সেই পথে আমাদের পথনির্দেশ করে পাশে হাঁটবেন রোজা লুক্সেমবার্গ- এক অনির্বাণ আলোকশিখা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...