রিল : এক
চুলো আছে, চাল নেই। চাল কেনার উপায় নেই। মৃণাল আর গীতা না-হয় উপোস দিতেই পারেন। কিন্তু, ছোট্ট কুণাল? তাকে না-খাইয়ে কেমন করে রাখবেন! খানিক অসহায় পায়চারি। মৃণাল বেরোলেন। কারও কাছে কিছু ধার পেলে চাল কেনা হবে। গীতার আশা : মৃণাল যখন বেরিয়েছেন, কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হবে। তাই তোলা আঁচটি জ্বেলে হাঁড়িতে জল বসিয়ে দিলেন। চাল আনতে আনতে জলটা তো গরম হোক!
মৃণাল ঘর থেকে বেরিয়ে আরও অসহায়। কার কাছে টাকা চাইবেন? কাকে বলবেন, আমার হাঁড়ি চড়ছে না, টাকা দাও! বন্ধুরা যাঁরা আছেন, তাঁদের নিজেদেরই চালচুলো নেই। তাছাড়া, মৃণাল তো কারও কাছে হাত পাততে শেখেননি, ছেলের মুখ চেয়ে হয়তো এবার হাত পাততে হবে। বন্ধুদের কাছে চাইতে দোষ কি! মনে অনেক দ্বিধা, অনেক দ্বন্দ্ব! শেষ পর্যন্ত দ্বিধারাই জিতে গেল। পারলেন না, কারো কাছে হাত পাততে পারলেন না। কেটে গেল নিছক ফুটন্ত জলে, অন্নহীন একটা দিন!
দারিদ্র্যের সঙ্গে আপোষহীন লড়াই আর আদর্শের সঙ্গে শিল্পের গাঁটছড়া বাঁধতে পেরেছিলেন বলেই এই মানুষটা একদা নির্মাণ করতে পেরেছেন-- 'একদিন প্রতিদিন', 'খারিজ', 'বাইশে শ্রাবণ', 'পদাতিক', 'আকালের সন্ধানে'। যাপন ও ভাবন একসঙ্গে না-মিললে এমন সার্থক ও সংবেদী সৃষ্টি সম্ভব নয়।
রিল : দুই
‘ইন্টারভিউ’ ছবিটা রিলিজ করলো। খুব স্মার্ট দুটি মেয়ে, কনভেন্ট-পড়ুয়া টাইপ। শো-শেষ। সিনেমা হলের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে তাঁদের দুই স্বরে একই বক্তব্য : ছবিটা বোগাস। ইটস আন অ্যান্টি-সোশ্যাল ফিল্ম। পিছনেই মৃণাল সেন। প্রথম কথাটা শুনে তাঁর মনটা দমে গেল। কিন্তু, ছবিটা ‘অ্যান্টি-সোশ্যাল’ শুনে মুখে ফুটে উঠল চিলতে হাসি। ‘যাক, তাহলে কিছু একটা অন্তত বানিয়েছি!’
‘ইন্টারভিউ’ এমন একটা ছবি, যা দেখে মুগ্ধতা আসে, বিস্ময় জাগে: এভাবেও ছবি বানানো যায়! অসাধারণ ফার্স। অনন্য ফর্ম। তথ্যচিত্র-সিনেমা-বাস্তব মিলিয়ে গল্প বলার ধরণটাই বদলে দিয়েছে এই ছবিটা। সে যেন এক মূর্তিমান প্রতিবাদ। মৃণাল সেই শিল্পী, যিনি প্রতিবাদী প্রোটাগনিস্টের হাতে ইট ধরিয়ে দিতে পেরেছেন। ইংরেজ চলে যাওয়ার পরও বাঙালির মজ্জা-অফিস-আদালত-শিক্ষা-স্বপ্নের ঘাড়ে চেপে থাকা সাহেবিয়ানার ভুতটিকে চিনিয়ে দিতে পেরেছেন। ম্যানিকুইনটার সাহেবী পোশাক ছিঁড়ে নাঙ্গা করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, রাগ মিটিয়েছেন, মধ্যবিত্ত-স্বপ্নের মিথ্যে মায়াজাল ছিঁড়তে চেয়েছেন। প্রতিবাদের এই ভঙ্গিটাই বঙ্গবাসী পাশ্চাত্যমুখী মহিলা-দর্শক দুটির হজম হয়নি। তাই, ছবিটা তাঁদের কাছে, ‘অ্যান্টি-সোশ্যাল’!
রিল : তিন
'একদিন প্রতিদিন’-ছবিতে ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাড়ির হাল ধরেছে বড় মেয়েটি। সে চাকরি করে। একদিন সারারাত সে বাড়ি ফিরল না। ফিরল একেবারে ভোরবেলায়। প্রতিদিনের ফেরার সময়ে না-ফেরা এবং ভোরে ফেরা--তার মধ্যিখানের সময়টুকু নিয়েই গল্প। টেনশন, অপেক্ষা আর অপেক্ষার পরতে পরতে বেরিয়ে এলো প্রত্যেকের স্বার্থপরতা, খুলে গেল দিনযাপনে প্রয়োজনের মুখোশ। ছবিটায় শেষ অব্দি স্পষ্ট করে কোথাও বলা নেই, মেয়েটি সারারাত কোথায় ছিল। মধ্যবিত্ত জীবনে সুস্থভাবে বাড়ি ফেরাটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল, একা একটা মেয়ে সারারাত কোথায় ছিল! যথারীতি ছবিটা দেখে এক ভদ্রমহিলা মৃণালকে প্রশ্নও করে বসলেন, ‘আচ্ছা মৃণালবাবু, মেয়েটা সারারাত কোথায় ছিল?’ মৃণাল পাল্টা প্রশ্নে উত্তর দিলেন, ‘আমি জানি না, আপনি কি জানেন?’
রিল : চার
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’-গল্পটি থেকে পূর্ণেন্দু পত্রী ‘স্বপ্ন নিয়ে’-নামে একটা ছবি করেছিলেন। ছবিটা প্রেমেন্দ্র মিত্রের পছন্দ হয়নি। কথায় কথায় মৃণালকে সেকথা একদিন বলেও ফেললেন। ‘ছবিটা কিচ্ছু হয়নি জানো, কিচ্ছু হয়নি...’। বলার মধ্যে অদ্ভুত একটা কষ্ট ছিল, শিল্পী মনের যন্ত্রণা ছিল। সেই যন্ত্রণা চেতনে-অবচেতনে ছুঁলো মৃণালকেও। কিন্তু, তাই বলে এ-গল্প নিয়ে ছবি বানানোর কথা তিনি একেবারেই ভাবলেন না। অথচ, কাকতালীয়ভাবে তাঁকে এ-গল্প নিয়েই ছবি বানাতে হল!
তখন ‘খারিজ’ ছবি করে ফেলেছেন মৃণাল। একদিন মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। এবার পরের ছবি তো করতে হবে, কিন্তু, কি নিয়ে করবেন? কোন বিষয়ে? সেই ভাবনায় অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করলেন। সে যেন এক দিশাহীন অবস্থা। তবে, এই রকম অবস্থায় পড়লেই তিনি একটা খেলা খেলেন। যে-কোন একটা বই টেনে নেন, তার যে-অংশটা এক টানে খোলে সেই অংশটা পড়তে শুরু করেন। এখন সেটাই করলেন। হাতে এলো, ‘প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প’। আর অদ্ভূতভাবেই এক টানে বইটা খুলতেই যে গল্পটা বেরোল, সেটা, ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’!
গল্পটা তিনি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললেন। একবার, দু’বার, কয়েকবার। মাথার মধ্যে ভিড় করতে লাগল ছায়া ছায়া ছবিরা। ঠিক করে ফেললেন, এটাই ছবি করবেন। কিন্তু, বাংলাতে তো আর করা যাবে না, করতে হলে হিন্দিতে করতে হবে। তাই সই। পরদিন সকালেই ছুটলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে। তাঁকে ছবির কথা বলতেই তিনি তো বেজায় খুশি, ‘করো করো, তুমি করলে ভালো হবে। তবে একটু তাড়াতাড়ি করো, চোখ দুটো শেষ হয়ে যেতে বসেছে, দেখো, ছবিটা যেন দেখতে পাই...’।
প্রেমেন্দ্রর দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছিল। তবে, তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাবার আগেই তাঁর ইচ্ছে পূরণ করতে পারলেন মৃণাল। অসম্ভব পরিশ্রমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করলেন, ‘খণ্ডহর’। রিলিজের আগেই স্পেশ্যাল স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা করলেন প্রেমেনের জন্য। অন্ধকার প্রেক্ষাঘরে ক্ষীণতর দৃষ্টি নিয়ে ছবিটি দেখে মুগ্ধ প্রেমেন ইচ্ছেপূরণের আনন্দে কেঁদে ফেললেন। আবেগে জড়িয়ে ধরলেন মৃণালকে। তখন, মানুষ ও শিল্পী মৃণালের মুখে ফুটে উঠল অনির্বচনীয় তৃপ্তি।
রিল : পাঁচ
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মৃণালের শ্রদ্ধার সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক। দু’জন দুই মনন ও মেজাজের শিল্পী। তাঁর ‘আকাশ কুসুম’ ছবিটি সত্যজিতের পছন্দ হয়নি, সেই অপছন্দের কথা সত্যজিৎ বলেছিলেন, লিখেওছিলেন। তাই নিয়ে দুজনের যুক্তি-প্রতিযুক্তিতে পত্রিকার পাতা উষ্ণ হয়েছে। কিন্তু, এই 'মতানৈক্য' পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহজ বন্ধুত্ব পেরিয়ে কখনই 'মনোমালিন্য' হয়ে ওঠেনি।
সত্যজিৎ একবার মৃণালকে দুঃখ করে বললেন, ‘কাদের জন্য সিনেমা বানাচ্ছি মৃণালবাবু! বন্ধুর মুখে অপর্ণার মৃত্যুর খবরটা শুনে শোকে অপু তাকে চড় মারল, এতেও তারা হেসে উঠল!’ মৃণাল বললেন, ‘ভুলটা কিন্তু আপনারই মানিকবাবু। চড় খাওয়ার পর আবার বন্ধুর রিয়াকশন লাগিয়েছেন। ওর বোকা বোকা রিয়াকশন দেখে দর্শক তো হাসবেই! তাদের দোষ কি, ভুলটা তো আপনারই।’ কথাটা শুনে সত্যজিৎ ভাবনায় ডুবলেন। কিন্তু, বিজয়া মৃদু প্রতিবাদে বললেন, ‘এ কী কথা বলছেন মৃণালবাবু...’। সত্যজিৎ তাঁকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘উনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই এটা ভুল হয়েছে।’
আসলে, ভুল মাস্টার্সদেরও হয়। এঁরা প্রকৃত শিল্পী এবং মহৎ স্রষ্টা ছিলেন বলেই একে-অপরের কাছে সৎ-ভাবে ভুল স্বীকার করতে বাধেনি। একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শিল্পের কাছে সৎ না-থাকলে এটা কখনই সম্ভব হত না।