ভারত মহাকাব্যের দেশ। রামায়ণ এবং মহাভারত উপমহাদেশের সংস্কৃতির অঙ্গ। রামায়ণের কেন্দ্রীয় চরিত্র রামচন্দ্র কীভাবে সীতা উদ্ধার করেছিল, বানর সেনার সাহায্যে রাবণকে কিভাবে পরাজিত করেছিল সেই কাহিনী জানে না বোধহয় এমন কেউ নেই। বলা যেতে পারে জীবন যাত্রার সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
রামায়ণের গল্পও নানা ভাবে বদলে গিয়েছে সময় সময়। রামায়নের চেনা গল্প অনেকটাই বদলে গিয়েছে স্থান ভেদে। বাল্মীকী রামায়নে রাবণ লঙ্কাপতি। ছল করে এসে অপহরণ করে নিয়ে যায় সীতাকে। সে কারণেই বাঁধে রাম রাবণের যুদ্ধ। এই কাহিনী আবার বদলে গিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণে। সেখানে রাবণ সীতার ‘জন্মদাতা পিতা’। কাহিনী শেষ হচ্ছে রাম-সীতার মিলনের খুশি দিয়ে।
এই কাহিনীই আবার আলাদা চমক দেয় তিব্বতী রামায়ণে।
রামায়ণ- এর ৩০০ টি ‘ভার্সান’-এর সন্ধান মিলেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২২ টি আলাদা আলাদা ভাষায়।
২৫০০ বছর আগে মূল রচনা করেছিলেন বাল্মীকী। সেখানে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্ম এবং অশুভ’র বিপরীতে শুভ’র জয় দেখানো হয়েছিল। রামায়ণ লেখার মূল উদ্দেশ্যও ছিল এক। বছরের পর বছর ধরে নানাভাবে তা এক দেশ থেকে আর এক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কখনও ভূ- পর্যটকদের মাধ্যমে। আবার মানুষের মুখে মুখে কথক কথার মাধ্যমেও।
চীন, নেপাল, বর্মা, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া, ফিলিপিনস-এর মতো দেশগুলোতেও রামায়ণের একাধিক সংস্করণ পাওয়া গিয়েছে।
মূল কাহিনী বদলে গিয়েছে মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে। লেগেছে স্থানীয় জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতির ছোঁয়া।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ড্যাংগুহাং- এর ম্যাগাও কেভ-এ খুঁজে পাওয়া যায় তিব্বতী রামায়ণের পান্ডুলিপি। চীন সীমান্তের সিল্ক রুটে। রামায়ণ পান্ডুলিপির সঙ্গে ৬ টি অসমাপ্ত পান্ডুলিপিও মিলে ছিল।
যা একজোট করলে একটি পূর্ণাঙ্গ রামায়ণের চেহারা নেয়।
চতুর্থ এবং একাদশ শতাব্দীতে তিব্বতী রামায়ণ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তবে এই রামায়ণের এই সংস্করণ বাল্মীকী রামায়ণের থেকে অনেকটাই আলাদা। বৌদ্ধ প্রভাবমুক্ত।
তিব্বতী রামায়ণে রাবণ ‘দশগ্রিভ’। সীতা তাঁর মেয়ে। কিন্তু যখন পিতার দ্বারা সে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে তখন সে একটি তামার বাক্সে নিজেকে বন্দি করে জলে ভেসে যায়। স্রোতে ভাসতে ভাসতে সে নদীর কিনারায় আটকে যায় এক সময়। এক চাষি তাকে উদ্ধার করে। দত্তক নেয় সেই কন্যাকে। নাম দেয় ‘রোলার্ত্মা’। আস্তে আস্তে বড় হয় রোলার্ত্মা। পাত্র খোঁজা শুরু হয় তার জন্য। রামানা নামে এক রাজপুত্রের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। রামান্না তার নতুন নাম দেয় ‘সীতা’।
‘বনবাস পর্বে’ দেখা যায়, রামান্না হরিণ শিকারের জন্য গভীর বনে গিয়েছে। সেখানে তার সঙ্গী হয়েছে ‘লগসানা’ অর্থাৎ লক্ষ্মণ। ‘দশগ্রিভ’ হাতির ছদ্মবেশে সীতার কুটিরে হানা দেয়। তারপর ঘোড়ার রূপ ধারণ করে।
পরবর্তী অধ্যায়ে তিন বানর সেনাপতির কথা কথা। পাগসু, সিন্দু আর হনুমান্ত। সীতার সন্ধাএ তাঁরা ‘দশগ্রিভ’- এর দেশে যায়। সীতার কাছে রামের চিঠি পৌঁছে দেয়।
তিব্বতি রামায়ণে ‘দশগ্রিভ’ অর্থাৎ রাবণের মৃত্যুটাও অন্যভাবে দেখানো হয়েছে। মূল রামায়ণ থেকে একেবারে আলাদা। কাহিনী অনুযায়ী, রামের ধনু থেকে তির ‘দশগ্রিভ’-এর মাথায় এসে বেঁধে। ধড় থেকে আলদা হয়ে যায় তার মাথা। অশ্ব মুন্ড। এভাবেই মৃত্যু হয় রাবণের।
শেষ অধ্যায়ে রাম সীতাকে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে বলেন না। রাবণের সংস্রবে থাকার কারণে চরিত্রনআশ ঘটেছে এই অভিযোগে তাঁকে দুইপুত্রসহ পরিত্যাগ করে। সেখানেই অন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় হনুমান ওরফে হনুমন্ত। সে রামকে বোঝায় সীত শুদ্ধ,পবিত্র। হনুমানের কথায় রাম সীতাকে ফিরিয়ে নেন।
তিব্বতী রামায়ণের শেষে বিচ্ছেদ, বেদনার রেশ রাখা হয়নি।
তিব্বতী রামায়ণের মূল পান্ডুলিপি লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রাখা। এছাড়াও প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ ফ্রান্সেও পান্ডুলিপির অংশবিশেষ দেখতে পাওয়া যায়।