বদলের শিল্পী গগন ঠাকুর
মেয়ের বিয়েতে বর পক্ষের সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন এক লক্ষ টাকার।
তাঁর ক্যারিকেচারে ছিল অন্য ধাঁচের রসবোধ। জুড়িগাড়ি নিয়ে মাঠে যেতেন মোহনবাগানের খেলা দেখতে। পা মাটিতে না পড়লেও খাতায় ঢেলে দিতেন নতুন আঁকা।
আধুনিকতা থেকে আধুনিকতাবাদ- এই সাঁকো পেরিয়েছেন আপন জৌলুসে। তাঁর ব্যঙ্গ চিত্রে বাঙালিয়ানার প্রভাব ছিল স্পষ্ট।
তিনি ভোঁদড় বাহাদুর এর স্রষ্টা। আদরের গগন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আঁকায় দেখা যেত জাপানি চিত্রকলার কেরামতি। কষ্ট করে শিখেছিলেন জাপানি ব্রাশ টেকনিক। চিনে-জাপানি অঙ্কনরীতির সঙ্গে নিজস্বতার রং মিশিয়ে উপহার দিয়ে গেছেন বহু ছবি।
কালের গর্ভ হাতড়ালে সেসব কি পাওয়া সম্ভব?ভাই অবন ঠাকুরের কীর্তিপাশে তিনি কি কুয়াশার আবছায়া? কাকা রবি ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’-র কিছু টুকরো ছবির নীচে তাঁর নাম দেখে কারও মন কেমন করে অলস দুপুরে!
অথচ শিল্পী-রক্ত বয়েছিল তাঁর শিরাতেও। নতুন গল্প বেরিয়েছিল তাঁর রঙ তুলি থেকেও।
কাকার মত গগন এরও মন চাইত না স্কুলের গণ্ডি মাড়াতে।সেসময়ের বিখ্যাত জল ছবি আঁকিয়ে হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর কাছে প্রথম কল্প লোকের তালিম নেওয়া।
ভাই অবন ঠাকুরের অন্তত দশ বছর পর গগনের আঁকিবুঁকি শুরু। ছিলেন ছোট ভাই পরিচালিত নব্য বঙ্গ ঘরানার শিল্পী।যদিও নিজেকে সেই ঘরানার চৌহদ্দির অনেক বাইরেই মেলে ধরতে পেরেছিলেন তিনি।
ছেলেবেলায় শখ ছিল সঙ্গীতের। সাহেবের কাছে শিখতেন পিয়ানো বাজানো। নিজের ছেলেদের সঙ্গীত শিক্ষায়ও রাখেননি কোনও ত্রুটি । যখন-তখন কিনে আনতেন বাদ্যযন্ত্র। এক্সপেরিমেন্ট চলত সুরের।
এদিকে কালের খাতায় লেখা চলছিল নতুন ভাগ্য লিখন। গগন ঠাকুর হতে চলেছেন পথিকৃৎ। ব্যতিক্রমী বিশ্বজনীনতায়। কিউবিক শিল্পচর্চায়।
ছেলের মৃত্যুশোক কাটিয়ে তুলতেই একপ্রকার তুলি- কালি- কলমের হাতে তুলেছিলেন।
হাইকোর্টে জুরির কাজে যেতেন একসময়। মাথা নিচু করে নোট নিতেন ব্যস্ত গগন। হাতে থাকত খাতা-পেনসিল।আসলে সেই ফাঁকেই চলছিল আঁকাআঁকি।বিচারকের হাতুড়ি ঠোকা থেকে সওয়াল-জবাব, উকিলের আনাগোনা— সবই উঠে আসত পোর্ট্রেটে।
উকিল, বিচারক, শ্রোতাদের চেহারার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসত অন্য অন্য চরিত্ররা।
কাজে মন ছিল ভরপুর।প্রকাশিত হতে থাকল ‘অদ্ভুত লোক’, ‘বিরূপ বজ্র’ আর ‘নব হুল্লোড়’।
রবীন্দ্রনাথ আরামকেদারায় বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছেন। সে ছবিও বেরিয়েছে গগনের তুলিতে। বাদ যাননি জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মহাত্মা গাঁধী— কেউ-ই।
মাঝে কিছু দিন চলেছিল ফোটোগ্রাফি চর্চাও। কিনে আনলেন ক্যামেরা। কালো কাপড়ে মুখ-মাথা ঢেকে, বিরাট স্ট্যান্ডে রেখে চলত ছবি তোলা। তেল রঙেও ভেসেছে শিল্পীর মন।যদিও জমে নি সে পালা।
খাতায় কলমে পাননি আঁকার তালিম।শিল্পের রসে টইটম্বুর থাকতো চোখ।সেখানেই ছিল শিল্পীর ইউ এস পি। আর ছিল শিল্পের সূক্ষ্ম বোধ।
সেই শিল্পবোধ ধরা দিল তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে। কখনও নাটকের মঞ্চসজ্জায়। কখনও পুরী-রাঁচি-দার্জিলিং সিরিজ়ের চিত্রে।
কুড়ির দশকের প্রথম দিকে শুরু ‘কিউবিক’ অর্থাৎ জ্যামিতিক চিত্রাঙ্কন । তাঁর ফ্যান্টাসি চিত্রনির্মাণের উৎসই এই কিউবিজ়ম। নিজের কল্পনার মিশেলে এই রীতি পেল দেশীয় ছোঁয়া।
ইউরোপের কিউবিজ়ম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি চলছিল গগনের আঁকা আঁকা খেলা। আলো-আঁধারি আর রহস্যে মোড়া রঙের খেলায় তাঁর ছবি নতুন আঙ্গিকে ধরা দিল।
বইয়ের দোকান থেকে নিত্য আসতে থাকে ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পীদের আঁকা ছবির বই। সঙ্গে এল শিল্পীদের সম্পর্কে লেখা বইও। গগাঁ, সেজান, রেনোঁয়া নির্মিত শিল্পের সার। তেল পুড়িয়ে বুঁদ হলেন পড়াশোনায়।
মনের ভাবনা আঁকা হয়ে ফুঁটতে শুরু করলো খাতায়।রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র প্রচ্ছদে থেকে গেল সে নির্মাণ।
ফ্যান্টাসি আর রোম্যান্টিসিজ়ম হয়ে উঠল তাঁর সত্তার দোসর । যেমন ‘ড্রিমল্যান্ড’ ছবিটি। অর্ধগোলাকৃতি খিলানের নীচ দিয়ে আজব দেশের উদ্যেশ্যে ভেসে চলেছে এক কাগজের নৌকা। তার উপরে ইন্দ্রধনুর মতো আলোর বিচ্ছুরণ। নৌকার ডান পাশের স্তম্ভটি নাট্যমঞ্চের দৃশ্যপটের এক ‘উইং’।
রূপকথা স্বতন্ত্র হয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর বোধে। কিছু ছবিতে এসেছে অন্য জগতের আভাস।চিত্র-বিশেষজ্ঞরা যাকে ‘ওয়ান্ডার ল্যান্ড’ আখ্যা দিয়েছেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনেও করেছেন পৃষ্ঠপোষকতা।ঠাকুরবাড়ি সাজিয়েছেন দেশীয় শিল্প-স্থাপত্যে। ‘বেঙ্গল হোম ইন্ডাস্ট্রি’, বাংলার কুটির শিল্পকে নতুন জীবন উপহার দেওয়া।
তিরিশের দশকে রক্তক্ষয়ে শয্যাশায়ী।তাও ব্যবস্থা করেছেন যামিনী রায়ের প্রদর্শনী।
একসময় গগন ঘিরে আসে আঁধারে। অস্তগামী সূর্য অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয় তারা। শরীর ছেড়ে দিতে হয় শিল্পীকে। আজকের তারিখে। শুধু বাংলার আত্মায় মিশে যায় শিল্পীর শেষ ছাই।
সেই ছাই নতুন গগন-এ শিল্পী পাওয়ার অপেক্ষায় আজও কুঁকড়ে কেঁদে ওঠে...