লণ্ডনে নিরঞ্জন পালের ড্রয়িংরুম। ১৯২৮ সাল। সাক্ষাৎ করলেন, এক হৃদয় অবাধ্য পুরুষ এবং এক হৃদয় অবাধ্য নারী। হিমাংশু রাই (রায়) এবং দেবিকারানি (চৌধুরী)। হিমাংশু দেখেছিলেন, রক্তসূত্রে বাঙালি হলেও দেবিকা কিন্তু যাকে বলে একেবারে, কেয়াবাৎ মেয়ে! বাবা-মাও বলিহারি। মাত্র ন'বছর বয়সের মেয়েকে সাউথ হাম্পস্টেড স্কুলে পড়ার জন্য ইংল্যান্ডের জাহাজে তুলে দিয়েছিলেন তাঁরা। অবশ্য আগে থেকেই মেয়ের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন এই নিরঞ্জন পালেরই বাড়িতে। এদিকে দেবিকাও নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল শেষ করলেন। সেইসঙ্গে লণ্ডনের একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টস এন্ড দ্য রয়্যাল একাডেমি অব মিউজিক থেকে সাম্মানিক বৃত্তিটিও আদায় করে ছাড়লেন। তারপরই তিনি পড়া শেষ করলেন আর্কিটেকচার ও কস্টিউম ডিজাইনিং নিয়ে। যোগ দিলেন ব্রিটিশ টেক্সটাইল কোম্পানিতে। 'স্বাবলম্বী মেয়ে'- বলতে যা বোঝায়, তিনি তা-ই হয়ে উঠলেন। নিরঞ্জনের বাড়ি ছেড়ে উঠে গেলেন ভাড়া বাড়িতে। বাবাকে চিঠি লিখলেন, তাঁকে আর টাকা পাঠাতে হবে না, নিজেরটা নিজেই চালিয়ে নিতে পারবেন। ইংল্যান্ড তাঁকে নিজেকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার স্বাধীনতা যেমন দিয়েছিল, তেমনি মেরুদণ্ড শক্ত করার শিক্ষাও দিয়েছিল। আর দিয়েছিল মোহময়ী হয়ে ওঠার মন্ত্র। সেই মন্ত্রে অনেকেই ঘায়েল হয়েছেন ইতিমধ্যে, এবার মুগ্ধ হলেন হিমাংশু। তিনি তখন বিবাহিত এবং এক কন্যাসন্তানের পিতা। হিমাংশুর স্ত্রী জার্মান ডয়েশ থিয়েটারের অভিনেত্রী মেরি হাইলিন, কন্যা নীলিমা। বিয়ের বয়স মাত্র চার বছর। তবু হিমাংশুর অবাধ্য হৃদয় পেতে চাইলো পিয়ানো বাজাতে জানা, গান জানা, চার বছর বয়সে নাটকে যে মেয়েটির অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়েছে, সেই মেয়েটি, দেবিকাকে। তাই হালকা সুতো ছেড়ে এই সাক্ষাতে একটি প্রস্তাবও দিলেন হিমাংশু, কিছুদিনের মধ্যেই দেশে ফিরে তিনি 'বম্বে টকিজ' নামের একটি সিনেমা-প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চান। দেবিকা যদি দেশে ফিরতে চান, তাহলে তাঁর প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন। মানে, যোগ দিলে ভালো হয় আর কি। আর এই মুহূর্তে একটা ছবির শ্যুটিং হবে দেশে, শ্যুটিং-এ এলে ভালো হয়। সুদর্শন পুরুষের চোখ সেদিন কথা বলেছিল। আর শব্দ? সেও তো বাক্যের বাইরে অনেক কথা বলেছিল; কাজেই মোহময়ী দেবিকা রাজি হয়েছিলেন।
হিমাংশু আর দেবিকা দুজনের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের একটি যোগ ছিল। শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময়কার প্রথম পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে একজন ছিলেন হিমাংশু। আর দেবিকা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নির মেয়ে। দুজনেই শৈশবে রবীন্দ্রস্নেহধন্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নায়িকা বিমলা ও এলার মধ্যে যে আগুন নির্মাণ করেছিলেন, সেই আগুনের পূর্বাভাস শিশু দেবিকার মধ্যেও দেখেছিলেন। তবে, হিমাংশু আর দেবিকার মধ্যে এই রবীন্দ্রসূত্রই কি জ্বলে উঠেছিল? কে জানে। তবে, দুজনের মধ্যে এই যোগাযোগ যখন হল, তখন হিমাংশু ছত্রিশ, দেবিকা কুড়ি। যদিও দেবিকার ক্ষেত্রে বয়সটা কোন ম্যাটার করেনি, যেমন করেনি হিমাংশুর ক্ষেত্রে তাঁর বিবাহিত জীবনের দায়।
হিমাংশু আর দেবিকার সাক্ষাৎ কি এই প্রথম হল, ১৯২৮ সালে? উঁহু। নিরঞ্জনের লেখা নাটক 'দ্য গডেস'-এ অভিনয় করতে গিয়ে ১৯২০ সালে হিমাংশু আর নিরঞ্জনের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। এর আগে থেকেই দেবিকা নিরঞ্জনের বাড়িতে আশ্রিত-অতিথি। এ-সময় হিমাংশু নিশ্চয়ই নিরঞ্জনের বাড়িতে একাধিকবার এসেছেন। অবশ্য ফ্রক পরা বছর বারোর দেবিকাকে দেখে পাত্তা না-দেওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া তখন হিমাংশুর সমবয়সী উদ্ভিন্না সুন্দরী বান্ধবীর অভাব তো ছিল না।
পাত্তা যখন দিলেন, তখন সেটা ১৯২৫ সাল। দেবিকা তখন নিরঞ্জনের আশ্রয় ছেড়ে স্বাধীন। এসময় নিরঞ্জনের চেষ্টায় ছবির শিল্প নির্দেশনা শেখার সুযোগ পেলেন দেবিকা। নির্বাক ছবি। ছবির নাম, 'লাইট অব এশিয়া', বাংলায় 'প্রেম সন্ন্যাস'। হিমাংশু এ ছবির নায়ক ও প্রযোজক। দেবিকা সতেরো বছরের যুবতী, অসম্ভব সুন্দরী, দারুণ স্মার্ট। সুতরাং, চোখে পড়লেন নায়কের। শুরু হল জানাশোনার সমীক্ষা। এরপর একটু একটু করে মেরির কাছ থেকে দূরে সরতে সরতে দেবিকার ঘনিষ্ঠ হতে লাগলেন হিমাংশু। বিচ্ছেদে শেষ হল মেরির সঙ্গে সম্পর্ক। আর ১৯২৮-এর সাক্ষাৎটি হল, দেবিকার সঙ্গে জীবন-শুরুর সলতেতে আগুন দেওয়া।
আবারও নির্বাক ছবি। ছবির নাম 'থ্রো অব ডাইস'। বাংলায়, 'প্রপঞ্চ পাশা'। শ্যুটিং ইউনিট এসে গেছে ভারতে। নিরঞ্জনের বাড়িতে বসে দেবিকাকে আসতে রাজি করিয়ে এসেছেন হিমাংশু। তাই অনতিকালেই তাঁদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন দেবিকা। ডিসেম্বর মাস পড়ল। রাজস্থানে শ্যুটিং শেষ করে ইউনিট এলো দিল্লিতে। এখানেই একান্তে দুজনে এনগেজড হলেন। এমনকি শ্যুটিং শেষ হতে-না-হতেই বিয়েটাও সেরে ফেললেন।
দুই উদ্দাম যুবক-যুবতী বাঁধা পড়লেন একটা সমাজ স্বীকৃত সম্পর্কে। সম্পর্ক স্বীকৃত হল বটে, তবে সুখের হলো না। এই বিয়েতে হিমাংশুর উদ্দামতার বেগ স্তিমিত হলেও দেবিকার হল না। পরকীয়া প্রেমের হাতছানি বার বার সংসারকে টালমাটাল করে তুলল; কিন্তু বিচ্ছেদ হল না। এই টালমাটাল শেষ হয়েছিল আটচল্লিশ বছর বয়সে হিমাংশুর অকাল মৃত্যুতে। সেসব দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস। তবে, দীর্ঘশ্বাসেও কখনো কখনো ইতিহাস নির্মিত হয়! কেননা, এই টালমাটাল পর্বেই দুজনে তৈরি করেছেন ভারতীয় সিনেমায় একের পর এক ইতিহাস।
বম্বের মালাড অঞ্চলে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ও জার্মান টেকনিশিয়ানদের নিয়ে 'বম্বে টকিজ' স্টুডিও প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আধুনিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, এই স্টুডিওর মধ্য দিয়ে অশোক কুমার, দিলীপ কুমার, মধুবালা-র মতো শিল্পীদের তৈরি করেছেন, আর শশধর মুখার্জি, মধু বসুর মতো টেকনিশিয়ান। হিমাংশু আর দেবিকা অভিনীত 'কর্মা' (১৯৩৩)-ছবি যে শুধু দীর্ঘ চুম্বন দৃশ্যের জন্য বিতর্কিত হয়েছিল তাই নয়, ভারতে তৈরি প্রথম ইংরেজি সবাক ছবি হিসেবেও ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এ-ছবিতে অভিনয়ে-উপস্থিতিতে সবার নজর একাই কেড়ে নিয়েছিলেন দেবিকা। তাঁকে নিয়ে
'The Era'-পত্রিকা লিখল-"Devika Rani's large velvety eye can express every emotion."
'Sunday Times'-পত্রিকা লিখল -"Very beautiful and fine artiste."
'The Heroine'-পত্রিকা লিখল- "One of the most dedicatedly glamourous cinema star ever seen."
'The News Chronicle'-পত্রিকা লিখল -- "She totally ellipses the ordinary film star, all her gestures speak, and she is great personified."
আর এভাবেই এখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টার দেবিকারানির যাত্রা, যা অব্যাহত ছিল পরবর্তী এগারো বছর ধরে। 'হামারি বাত' (১৯৪৩) অব্দি। তারপর তিনি অবসর নিয়েছিলেন ছবির জগৎ থেকে। পার্থিব জগতে বেঁচে ছিলেন আরও পাঁচটা দশক, আর দর্শকের মনজগতে বেঁচে আছেন আজও।