সমরেশ মজুমদার: আত্মপ্রকাশের উপাখ্যান

কোন কোন লেখকের লেখা একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না-করে কিছুতেই ছাড়া যায় না; তাঁদের লেখার 'প্রসাদগুণ' পাঠককে নাকে দড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে নেয়; আবার শুধু পড়িয়েই ক্ষান্ত হয় না, অন্যরকম একটা ভালোলাগার রেশ সমস্ত চেতনায় বহুকাল ধরে বইয়ে রাখে। এই গোত্রেরই একজন শক্তিমান লেখক সমরেশ মজুমদার

বস্তুত লেখক হওয়ার ইচ্ছে বা স্বপ্ন কোনটাই সমরেশের আবাল্য ছিল না। তাঁর লেখক হয়ে ওঠাটা যেন পাকেচক্রেই ঘটে গিয়েছিল। কোন পাকে (বিপাকেও বলা যায়) এবং কাদের চক্রে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেটা একটা ঘটনা।

ঘটনাটা ঘটেছিল গত শতকের ছয়ের দশকে। সমরেশ তখন কলকাতায় থেকে কলেজে পড়েন। বন্ধুদের নিয়ে নাটকের দল তৈরি করে মঞ্চে নাটক করেন। সেই সময় স্বপ্ন ছিল একটাই, চাকরি নিয়ে কাজকর্মের পাশাপাশি গ্রুপ থিয়েটার চালিয়ে যাওয়া।

 

somoreshmozumdar1

 

তো, এভাবে চলতে চলতে বেশ কয়েকটি বাজার চলতি পুরনো নাটক অভিনয় করা হয়ে গেল। কিন্তু তাতে দলের হালে পানি জুটল না। তখন গ্রুপের সকলেই ভাবলেন যে, এবার একেবারেই নিজস্ব একটি আনকোরা নাটক মঞ্চে নামাতে হবে। নইলে আর মান থাকছে না। মুশকিল হল, পেশাদার কাউকে দিয়ে নাটক লেখাতে গেলে তো যথেষ্ট দক্ষিণা দিতে হবে। ছোট দল, তার ওপর ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থায় সেটা কি সম্ভব? তার চেয়ে নিজেরাই লিখতে হয় না? তাতে ওটুকু টাকা অন্তত সাশ্রয় হয়। সে তো হয়; কিন্তু প্রশ্ন উঠল, লিখবে কে?

সমরেশ কলেজ পড়ুয়া, তায় আবার সাহিত্যের ছাত্র। ফলত গ্রুপের পরিচালকমশাই হঠাৎ লেখক হিসেবে তাঁকেই দেখিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠলেন, কেন, ওই তো সমরেশ, ও লিখবে!

তাঁর কণ্ঠে এমন একটা কিছু ছিল, যার জোরে হঠাৎ এমন একটা আনকোরা কাজে নিজের নাম প্রস্তাবিত হতে দেখে সমরেশ মোটেই আকাশ থেকে পড়লেন না; কোথা থেকে যেন একটা অমোঘ আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেলেন। ভাবলেন, কত ভালো ভালো সাহিত্য এতকাল ধরে তো পড়লাম, সেগুলো পুঁজি করে একটা নাটক লিখতে পারব না? নির্ঘাত পারব, নিশ্চয়ই পারব।

 

somoreshmozumdar2

 

ব্যস, প্রস্তাবে সমরেশ রাজি হয়ে গেলেন। এবং উৎসাহের চোটে অবিলম্বে লিখতেও বসে গেলেন। লেখা একটা শেষ করলেন বটে, কিন্তু সেটাতে না-ছিল গল্প, না-হল নাটক। স্বভাবতই কারও পছন্দ হল না। তবে তাঁরা সমরেশকে মোটেই হাল ছাড়তে দিলেন না। সমরেশও হাল ছাড়লেন না। ক'দিনেই নতুন করে আর একটা লেখা তৈরি করে ফেললেন। এবারেও লেখাটা নাটক হল না বটে, তবে মোক্ষম একখানা গল্প কিন্তু হয়ে উঠল।

গল্পটা গ্রুপের সকলের দারুণ লাগল। সমরেশকে বললেন এতটা ভালো যখন হয়েছে, তখন লেখাটি একটি সাহিত্য পত্রিকায় দিয়ে আসতে। যদি ছাপে, তাহলে একটা দারুণ ব্যাপার হবে। কথাটা সমরেশের বেশ মনে ধরল।

সাপ্তাহিক 'দেশ' তখন আভিজাত সাহিত্য পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথমসারিতে। সমরেশ ভাবলেন, গল্প দিতে হলে ওখানেই দেবেন, তারপর যা থাকে কপালে!

বেশ। একদিন অফিসে গিয়ে গল্প দিয়ে এলেন।

তারপর অপেক্ষার পালা। সে-সময় গল্প মনোনীত হলে খবর আসত, না-হলে লেখা ফেরৎ আসত। কিন্তু দিন যায়, খবর আসে না, লেখাও আসে না...। একদিন আর ধৈর্য্য ধরল না। সটান হাজির হলেন গিয়ে অফিসে।

 

somoreshmozumdar3

 

তখন গল্পের দপ্তর সামলাতেন সাহিত্যিক বিমল কর। সমরেশ তাঁকে একেবারেই চিনতেন না। গল্পলেখক হিসেবেও না। নামও জানতেন না। ফলে, সামান্য কলম-পেষক ভেবে নিজের পরিচয় দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, গল্পটির কী গতি হল? বিমল জানালেন যে, দু'সপ্তাহ পরেই গল্পটি ছাপা হবে। স্বভাবতই খবরটা শুনে সমরেশের আনন্দের আর সীমা রইল না।

সেই আনন্দের খবরটা দলের বন্ধুদের দিতেই তাঁরা একেবারে হামলে পড়লেন সেলিব্রেশনের জন্য। সমরেশের পকেট হাতড়ে চারটে টাকা হাতিয়ে নিয়ে সোজা কফিহাউস। তারপর কফি ও পকোড়ায় আনন্দযাপন।

আনন্দের রেশ দু'দিনের বেশি রইল না। মেসের ঠিকানায় গল্প ফেরৎ এল। তার সঙ্গে একটি চিঠি। তাতে লেখা, গল্পটা মনোনীত হয়নি!

সমরেশ তো পুরো ফিউজ। এটা কী রকম হল! এত উল্লাসের পর এবার বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাবেন কেমন করে! অমনোনীতই যদি, তাহলে অফিসের সেই লোকটা মিথ্যে বলল কেন! আনন্দ, উল্লাস, উদযাপন, আশাভঙ্গ, লজ্জা--এ-সবের মূলে ওই লোকটাই! সব রাগ গিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। লোকটাকে তো সহজে ছেড়ে দিলে হবে না। অফিসে গিয়ে তো কিছু বলা যাবে না। কাজেই ফোন করে লোকটাকে উদোম গালাগালি দিয়ে গায়ের ঝাল মেটাতে লাগলেন সমরেশ।

 

somoreshmozumdar4

 

কিন্তু দেখা গেল, লোকটা নিতান্তই একজন সহৃদয় মানুষ। তিনি ফোনের ওপ্রান্ত থেকে একটুও রাগলেন না, এই দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবলেন না; বরং সমরেশ কখন চুপ করেন, তার জন্য অপেক্ষা করলেন। তারপর কথা বলার সুযোগ পেয়ে বললেন, গল্পটা নিয়ে অফিসে আসতে। আসলে পিওনকে তিনি গল্পটা প্রেসে দিতে বলেছিলেন, বুঝতে না-পেরে সম্ভবত সে ভুল করে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে। যাই হোক, গল্পটি পরের সপ্তাহে প্রকাশ পাবে।

ব্যবহার-লজ্জিত সমরেশ গল্পটি আবার দিয়ে এলেন অফিসে। এবং, এবার সত্যি সত্যিই নির্ধারিত সময়ে সাপ্তাহিক 'দেশ'-এ তা প্রকাশিত হল। গল্পটির নাম, 'অন্তরাত্মা'

এভাবেই লেখক সমরেশ মজুমদারের আত্মপ্রকাশ ঘটল। এই আত্মপ্রকাশে যতটা থিয়েটার-বন্ধুদের অবদান রয়েছে, তার চেয়ে বেশি রয়েছে 'সেই লোকটা'র অর্থাৎ সহৃদয় সাহিত্যিক বিমল করের। তিনি সহৃদয় না-হলে, ভদ্রলোক না-হলে এ আত্মপ্রকাশ সম্ভব হত না। পরে অবশ্য সমরেশের সঙ্গে তাঁর একটি অকৃত্রিম স্নেহমধুর আন্তরিক একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা আজীবন অব্যাহত ছিল।

যাই হোক, 'দেশ'-এর পাতায় গল্প লিখে গল্পকার সমরেশের যেমন আত্মপ্রকাশ, তেমনি ঔপন্যাসিক সমরেশের আবির্ভাবও এই পত্রিকার পাতাতেই। ১৯৭৫ সালে এক বিশেষ সংখ্যায় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দৌড়' প্রকাশিত হয়। তারপর একে একে এই পত্রিকার পাতাতেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর 'উত্তরাধিকার', 'কালবেলা', 'সাতকাহন'-এর মতো কালজয়ী লিখনমালা।

আসলে, বৈচিত্র্যময় কাহিনির প্রাচুর্য আর কাহিনির স্বচ্ছন্দ প্রবহমানতা তাঁর লেখার বিশেষ আকর্ষণ। তাঁর নারীচরিত্রেরা আত্মমর্যাদা ও মূল্যবোধের শক্তভূমিটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায়শই সমগ্র উত্তরবঙ্গ হয়ে ওঠে তাঁর পাঠকের কাছে জন্মভূমি জীবনভূমি। জনপ্রিয়তাকে সঙ্গে নিয়েও তাঁর কলম কালজয়ী, অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এখনও অক্লান্ত...

তথ্যঋণ:

সমরেশের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...