একলা বসে। মাথা নিচু। পুরো মুখ দেখা যায় না। ঝরঝরিয়ে কাঁদছে মেয়ে। আগে কখনও এমন আকুল হয়ে তাকে কাঁদতে দেখা যায়নি। আজ যে পিতৃহারা সে। আমূল কন্যা কাঁদছে। এর আগে কেউ তাকে কখনও এমন মনখারাপে দেখেনি। তাই গোটা দেশের মন খারাপ।
গতকাল মঙ্গলবার মুম্বইতে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আমুল কন্যার স্রষ্টা সিলভেস্টার দা কুনহা। অ্যাড গুরু হিসেবে তিনি সারা বিশ্বে জনপ্রিয়।
— R S Sodhi (@Rssamul) June 21, 2023
গোলগাল আদুরে চেহারা। মাথায় নীল চুলে ঝুঁটি। গায়ে পোলকা ডট ফ্রক। নাকছাড়া মুখে গোলগোল চোখ আর মিচকে হাসি। তাকে দেখলেই যেন খিদে খিদে পায়। যখনই চোখ যায় তার হাতের গলে পড়া হলুদ ‘বাটার’র দিকে। এই দিয়ে সে মন জয় জিতেছিল গোটা দেশের। বড় আদরের ‘আটারলি বাটারলি গার্ল’ আমূল কন্যা।
দুষ্টুমিষ্টি বালিকা কিন্তু তার রসবোধটি তুখোড়। রাজনীতি থেকে খেলা, দেশের কোন প্রান্তে কী ঘটে চলেছে সব দিকে তার নজর। সে সব নিয়ে যখন সে যা বলে সেটাই হয়ে যায় ‘কোট অফ দ্য ডে’। মাখন আপনি খান বা না খান, এই বালিকাকে এড়ানো দুঃসাধ্য! গত ৫৭ বছর ধরে এটাই দেশের চর্চা!
এভাবেই মেয়েকে গড়েছিলেন বাবা সিলভেস্টার দা কুনহা।
১৯৬৬ সাল। তার ঠিক দশ বছর আগে মানে ১৯৫৫ সালে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘ ব্র্যান্ড আমুল’। ‘সাদা বিপ্লবের’ সাক্ষী হয়েছে দেশবাসী। সেই বিপ্লবের উৎসভূমি গুজরাট হলেও আসমুদ্রহিমাচলকে স্পর্শ করেছিল সফেদ ঢেউ। সাদা বিপ্লবের জনক ভার্গিস কুরিয়েনের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল আমুলের পথ চলা।
বিপ্লবের সঙ্গী হয়েছিলেন সিলভেস্টার দা কুনহা। সাধারণ মানুষের কাছে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদক সংস্থাকে পরিচিত করার জন্য বিজ্ঞাপন জগতের অন্যতম কিংবদন্তী সিলভেস্টার দা কুনহাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভার্গিস কুরিয়েন।
ডাকুনহা কমিউনিকেশনস বিজ্ঞাপন সংস্থার প্রধান এই কাজে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন ইলাস্ট্রেটার ইউসটেস ফার্নান্ডেজ এবং ঊষা কাটরাককে। তাঁদের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে জন্ম নেয় মাথায় ঝুঁটি বাঁধা, লাল-সাদা ফ্রক পড়া দুষ্টমিষ্টি এক মেয়ে। ভারতবাসীর কাছে তাকে ‘আমুল কন্যা’ হিসেবে হাজির করেন সিলভেস্টার।
আমুল গার্ল’ ক্যাম্পেইন শুরুর তিন বছর পর, গারসন এবং সিলভেস্টার মিলে ১৯৬৯ সালে আমুল গার্লকে নিয়ে দাকুনহা কমিউনিকেশন তৈরি করেন।
গত ৫৭ বছর ধরে দেশের প্রতিটি ঘরে-ঘরে পৌঁছে গিয়েছে ওই আমুল কন্যা। এতটাই জনপ্রিয় আটারলি-বাটারলি গার্ল যে আমুলের পরিচালন সমিতিতে বার বার বদল ঘটলেও আমুল কন্যার কোনও বদল হয়নি।
আমূলকে ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরতে তিনি যে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলেন তা ছিল একেবারে নতুন। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে কোনো সেলিব্রিটির মুখ নয়, তিনি সম্পূর্ণ এক অন্যরকম ভাবনা আনলেন। পলকা ডট ফ্রক পরা এক কার্টুন বালিকা। ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল সেই মেয়ে। বিখ্যাত ক্যাচলাইন 'আটারলি বাটারলি ডেলিশাস' লিখেছিলেন সিলভেস্টারের স্ত্রী নিশা ডাকুনহা৷
পলসন বাটারকে টেক্কা মারার জন্য কু্যরিয়েন দায়িত্ব দিয়েছিলেন দাকুনহা কমিউনিকেশনসকে৷ তাঁর একটাই কথা ছিল৷ পলসনের বিজ্ঞাপনে যে বিদেশি মেয়েটিকে দেখি তার প্রতিদ্বন্দ্বী এক চরিত্র তৈরি করতে হবে ডাকুনহাকে৷
বিজ্ঞাপনের একেবারে শুরুতে অবশ্য আমূল কন্যের পরনের এই পলকা ডট ফ্রকটি ছিল না। তিন নম্বর বিজ্ঞাপন থেকে। তার আগের চেহারা ছিল অন্যরকম।
প্রথম থেকেই এই বিজ্ঞাপন ছিল কেবলমাত্র হোর্ডিং কেন্দ্রিক৷ প্রতি মাসে প্রকাশিত হত একটি বিজ্ঞাপন৷ ৭০-৮০-র দশকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর একটি করে৷ ৯০-এর দশকে প্রতি সন্তাহে একটি৷ একবিংশ শতাব্দির গোড়া থেকেই প্রতি সন্তাহে ৫টি৷
আমূল কন্যা কী বলবে, কী করবে সে নিয়ে আমূল সংস্থা কোনওদিন তেমনভাবে কিছু বলেনি সিলভেস্টার দা কুনহাকে। ব্রিফ ছিক শুধু একটাই- মাখন বিক্রি করতে হবে’।
ভারতের আমজনতার মনের কথা বলতে পেরেছিল আমূল কন্যা। সহজ ভাষা সহজ কথায় সেটাই তার মত। মাঝে মাঝে তার টিপ্পনিতে রাগ হতে পারে, গা চিড়বিড় করতে পারে, তবে সেটাই জনতার মনের কথা। মনের কথা মুখে এনেই দেশবাসীর মন জিতেছে কন্যে। অনেকবার বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে, কিন্তু বদলায়নি সেই মেয়ে। রয়ে গিয়েছে একইরকম ঠোঁটকাটা। সেই জন্যই ভারতের সকাল সন্ধের পাউরুটি বিস্বাদ ‘আটারলি বাটারলির’ টাচটুকু ছাড়া!