দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচেছিলেন তিনি ও তাঁর কলম; জন্ম শতবার্ষিকীতে অমৃতা প্রীতম

১০০ বছর আগে, আজকের দিনেই পাঞ্জাবের মান্দি গুজরানওয়ালায় জন্মগ্রহণ করেন অমৃতা প্রীতম, যা বর্তমানে রয়েছে পাকিস্তানের অধীনে। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও ছোটো গল্পকার। জীবিতাবস্থায় সৃষ্টি করে গেছেন একের পর এক যুগান্তরকারী লেখা। সারা জীবন সন্মানিত হয়েছেন অসংখ্য পুরষ্কারে। ১৯৪৭-এর দেশভাগ চূড়ান্ত প্রভাব ফেলেছিল তার জীবনে। লেখনীতেও বারবার উঠে এসেছে সেইসব প্রসঙ্গ। ১০০ বছর পরেও আজকের দিনে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক এই লেখিকা।

বিশ শতকের ভারতীয় মহিলা কবিদের তালিকা ঘাঁটতে গেলে অবধারিতভাবে প্রথম সারিতে পাওয়া যাবে তার নাম। মূলত পাঞ্জাবি ও হিন্দি ভাষায় লিখে গেছেন বহু গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও প্রবন্ধ। তৎকালীন পাঞ্জাব ছিল ব্রিটিশশাসিত, ফলে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশের মানুষকেই আপন রূপে দেখতেন অমৃতা। এই দুটি দেশ ব্রিটিশরাজ থেকে মুক্তি পেয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে উন্নীত হলেও দুই দেশেই সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেন অমৃতা। সারাজীবনে ১০০টিরও বেশী গ্রন্থ মুদ্রিত হয়েছে, কবিতা, প্রবন্ধ, ফিকশন, উপন্যাস, জীবনীর মতো ফর্মগুলি ছাড়াও পাঞ্জাবি লোকগানের একটি সংকলন মুদ্রিতাধিকার পায় তাঁর সজীব কলমের ছোঁয়ায়। তাঁর রচিত আত্মজীবনী বহু ভারতীয় ভাষা ছাড়াও বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

FotoJet (171)

মা রাজ বিবি ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা, বাবা কর্তার সিং হিতকরী ছিলেন সে সময়ের অন্যতম কবি এবং ব্রজ ভাষার পন্ডিতবর্গের একজন। একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজও কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কর্তার সিং। মাত্র ১১ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু হলে বাবার সাথে লাহোর পাড়ি দেন অমৃতা, ১৯৪৭-এর দেশভাগের দিন পর্যন্ত সেখানেই তারা জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। অল্প বয়সে মাকে হারানোর ফলে যাবতীয় দায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল অমৃতাকে, জীবন কাকে বলে তা সেই বয়সেই উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন, আর তার ফলস্বরূপ তখন থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন অমৃতা। ১৯৩৬ সালে প্রথম কবিতার সংকলন ‘অবিনশ্বর তরঙ্গ’ (Immortal Waves) প্রকাশিত হয়। সে বছরই ১৬ বছর বয়সে প্রীতম সিং এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের আগে তাঁর নাম ছিল অমৃতা কৌর। বিয়ের পর নাম পরিবর্তন করে অমৃতা প্রীতম রূপে জনসমক্ষে নিজেকে উপস্থাপিত করেন তিনি।

প্রেমের কবিতা দিয়ে জীবন শুরু করলেও তৎকালীন সময়ে ঘটে চলা দেশভাগ, দাঙ্গা, মন্বন্তরের ক্রমপরিণতিতে অচিরেই প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন অমৃতা। ১৯৪৩ এ বাংলায় ভয়ঙ্কর মন্বন্তরের পর ১৯৪৪ এ ‘মানুষের যন্ত্রণা’ (People’s anguish) গ্রন্থে যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতি নিয়ে তুমুল সমলোচনা করেন তিনি।   

দেশভাগ সংক্রান্ত তথ্যচিত্র ‘গরম হাওয়া’ খ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এম.এস.সাথ্যু, অমৃতার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে একটি বিরল থিয়েট্রিকাল ট্রিবিউট দিয়েছিলেন, ‘এক থী অমৃতা”।

১৯৪৭ এ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া দু’ভাগে বিভক্ত হলে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবলে পড়ে প্রাণ হারান। দেশভাগের ফলে ২৮ বছর বয়সে লাহোর থেকে দিল্লীতে চলে আসেন অমৃতা। তখন তিনি সন্তান সম্ভবা। দেরাদুন থেকে দিল্লী যাওয়ার পথে হস্তধৃত কাগজের টুকরোয় একটি কবিতা লিখে ফেলেন, ‘আজ আক্ষান ওয়ারিশ শাহ নু’ (আজ ওয়ারিশ শাহ’কে জানাচ্ছি)। ওয়ারিশ শাহ ছিলেন তাঁর জন্মভূমির একজন সুফি কবি, বিখ্যাত ‘হীর রাঞ্ঝা’ কাহিনীর স্রষ্টা। তাকে উদ্দেশ্য করেই এই কবিতাটি লিখেছিলেন অমৃতা। পরবর্তীকালে কবিতাটি বহুল সংখ্যক মানুষের দ্বারা পঠিত হয় এবং দেশভাগ সংক্রান্ত বার্তার অপার্থিব মর্মরধ্বনি অচিরেই কবিতাটির অংশ হয়ে ওঠে।

“তোমার কবর থেকে বলছি

আর ওল্টাচ্ছি তোমার প্রেমের গ্রন্থের পরবর্তী পৃষ্ঠা

একদিন, পাঞ্জাবের একটি মেয়ে কেঁদেছিল এবং তুমি লিখে ফেলেছিলে গোটা একটা কাহিনী,

আজ, এক লক্ষ মেয়ে তোমার জন্য কাঁদছে, ওয়ারিশ শাহ,

ওঠো! হে শোকগাঁথার কথক! তোমার পাঞ্জাবের দিকে তাকাও,

আজ, মৃতদেহের সারিতে ভরে গেছে মাঠ আর চেনাব* এখন বয়ে চলেছে রক্তের ধারাপ্রবাহের সাথে”

এরপর ১৯৬১ পর্যন্ত দিল্লীর ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র পাঞ্জাবি মাধ্যমে বেশ কিছু বছর চাকরি করেন তিনি। এই অভিজ্ঞতা নতুন কিছু ছিল না তাঁর কাছে। দেশভাগের আগে লাহোরের একটি বেতার মাধ্যমে কিছুদিন চাকরি করেছিলেন অমৃতা, আর তার সূত্র ধরেই এই কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াটি সহজ হয়ে ওঠে। ১৯৬০ এ বিবাহবিচ্ছেদের পর তার লেখনীতে প্রবলভাবে নারীবাদী কন্ঠস্বর ধরা পড়ে। তাঁর সে সময়ের কবিতা ও গল্পগুলি ছিল মূলত অসুখী বিবাহজীবনের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। আত্মজীবনী ‘কালো গোলাপ’ ও ‘রশিদি টিকিট’ সহ তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ জর্মান, ফরাসি, জাপানী ও আরও বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা করা হয়।

১০৫০-এ লেখা তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘পিঞ্জর’ সামাজিক অস্থিরতা এবং নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলিকে নিরংকুশভাবে উপস্থাপিত করে। ২০০৩ সালে তাঁর কাহিনী নিয়ে এই শিরোনামেই একটি হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যা ২০০৪ এ জাতীয় সংহতির জন্য শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম বিভাগে জাতীয় পুরষ্কার অর্জন করে। ১৯৫৬ সালে তিনি তাঁর দীর্ঘ কবিতা সুনেহেদে’র (বার্তাগুলি) জন্য প্রথম মহিলা হিসেবে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কারে সন্মানিত হন। এখানেই শেষ নয়, ১৯৮১ তে ‘কাগজ ও ক্যানভাস’ উপন্যাসের জন্য তাঁকে ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার প্রদান করা হয়। ১৯৬৯ এ পদ্মশ্রী ও ২০০৪ এ পদ্মবিভূষণের পর, ২০০৫ এ সাহিত্য আকাদেমী সর্বোচ্চ সন্মান ‘অমর সাহিত্য’ অর্জন করেন এই লেখিকা।  

FotoJet (170) 

আজ, এই বিশেষ দিনে, শিল্পী বৃন্দা জাভেরি’র সহায়তায় জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গুগল ডুডলে ধরা পড়েছে তাঁর আত্মজীবনী ‘কালা গুলাব’-এর প্রসঙ্গ। তাঁর রচনা শুধু দেশীয় পাঠক মহলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ক্রমাগত সীমানা লঙ্ঘন করে পৌঁছে গেছে সমগ্র বিশ্বের কাছে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যখন দেশ জুড়ে আরও একটা যুদ্ধ জিগির মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন মান্টো, অমৃতার মতো সাহিত্যিকদের পাঠ ভীষণভাবে প্রয়োজনীয়। তাঁদের মতো সাহিত্যিকরা ছিলেন দুটি দেশের বন্ধনসেতু। অনুরাগী পাঠকদের কাছে আজকের দিনটি নিঃসন্দেহে গভীর বার্তা প্রেরণ করে, পাশাপাশি চিরায়ত জ্ঞানালোকে সমুজ্বল প্রতিবাদের নারীকন্ঠ হিসেবে চোখের সামনে আরও একবার উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অমৃতা প্রীতমের আরক্তিম জয়গাঁথা। 

 

(*চেনাব-একটি নদীর নাম)

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...