আঁধার পেরিয়ে বাঁচার প্রেরণা দেয় শিল্প। কোভিড-জনিত লকডাউনের মধ্যে মানুষ গভীরভাবে তা অনুভব করেছে। ২০২০-র শেষলগ্নে সেই সত্যিটাই যেন নতুন করে উদযাপিত হল ‘আমি আর্টস্ ফেস্টিভাল’-এ। আয়োজনে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)।
পেইন্টিং, ভাস্কর্য, নাচ, গান, ওয়ার্কশপ, কেনাকাটি, শিল্প-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অফলাইন ও অনলাইন আলোচনাসভা, স্লাইড-শো নিয়ে জমজমাট শৈল্পিক পরিবেশ, যেখানে মূলধারার সংস্কৃতি ও লোকশিল্প এসে মেলে। ১৭-২০ ডিসেম্বর – টানা চারদিন ধরে যা রূপ পেল ইএম বাইপাসের ধারে ইমামি গ্রুপের এই শিল্পকেন্দ্রে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীন ইজেডসিসি-র ডিরেক্টর গৌরি বসু, ইতালির কনসাল-জেনারেল জানলুকা রুবাগোত্তি এবং জাপানের কনসাল-জেনারেল নাকামুরা য়্যুতাকা। প্রদর্শনীতে জায়গা পায় পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা দেশের প্রায় ১৫০ জন নামী ও উদীয়মান শিল্পীর ৩৫০টি শিল্পকর্ম।
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাটির গন্ধ নিয়ে আসা লোকশিল্পীরা ও তাঁদের কাজ এই উৎসবের বিশাল প্রাপ্তি। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, লকডাউনের আর্থিক ক্ষতির পর শিল্পীদের পায়ের তলার জমি ফেরানো।
যেমন, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়-লাগোয়া চড়িদা গ্রাম থেকে আসা দ্বিজেন সুত্রধর। নিজেদের হাতে তৈরি ছৌ-মুখোশের পসরা সাজিয়েছিলেন। বললেন, ‘সাত প্রজন্ম ধরে আমাদের এই কাজ। এমনিতে এপ্রিল থেকে অগস্ট প্রচুর বিক্রিবাটা হয়। লকডাউনে ছৌ-শিল্প মার খেয়েছে। মুখোশের মেটেরিয়াল কিনতে ব্যাঙ্ক থেকে ৫ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলাম। তৈরি জিনিস ঘরে স্টক হয়ে আছে। বিক্রি হয়নি। এখন এরকম কিছু কর্মসূচি কিছুটা আশা দিচ্ছে।’
অনুপম শোলাশিল্পের নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন বীরভূমের কিন্নাহারের বর্ষীয়ান শিল্পী অনন্ত মালাকার। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের থেকে ‘শিল্পগুরু’ উপাধি পেয়েছেন। অতিথি হয়ে আমেরিকা-কানাডা-রাশিয়াতে গেছেন। লকডাউনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, ‘খেতে পাইনি এমন অবস্থা। সংসার চালাতে ঋণে ডুবে গেছি। দশমাস পর এই প্রথম কাজ নিয়ে গ্রামের বাইরে আসার সুযোগ এল।’
পূর্ব মেদিনীপুর থেকে রানি চিত্রকর ও সুষমা চিত্রকর এবং পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে নুরদিন চিত্রকর এসেছিলেন পটচিত্র আর পটের গান নিয়ে। রাধাকৃষ্ণ-মনসামঙ্গলের পৌরাণিক গল্প থেকে শুরু করে করোনা-সুনামির মতো আধুনিক আখ্যান-নির্ভর পালাগানে শহুরে আসর মাত করলেন তাঁরা। নুরদিন ইসলামে দীক্ষিত। আবার শিব-পার্বতী-সত্যপীর-গাজিপীর নিয়ে পট আঁকেন, গান বাঁধেন। বললেন, ‘শিল্পীর কোনও জাত হয় না।’
মালদহের কুতুবপুর থেকে এসেছিল ‘গম্ভীরা নাচ’-এর দল। বোলপুর থেকে কাঠখোদাই শিল্পীরা। ছিল ডোকরা শিল্পসম্ভার। টুসুনাচ-ভাদুগান, কবীরের ভজন, ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী - সবই উৎসবকে রঙিন করেছে। ফেসবুকে লাইভ-স্ট্রিমিং হয়েছে সবকটি অনুষ্ঠানের। ছিল স্মার্টফোনে কোড স্ক্যান করে ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রদর্শনী ঘুরে দেখার যুগোপযোগী ব্যবস্থাও।
পাশাপাশি ছিল চ্যালেঞ্জ। কেসিসি-র ডিরেক্টর রীনা দেওয়ানের কথায়, ‘প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে শিল্পীরা আসতে পারবেন কিনা ভয় ছিল। কিন্তু আমাদের এটা করতেই হত। কারণ এই লোকশিল্পীদের রোজগারের আর কোনও রাস্তা নেই। পাশাপাশি, লকডাউনে এমন কথা উঠেছে যে, শিল্পের নাকি দরকার নেই! কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়। তাই একটা পরিসর বানাতে চেয়েছিলাম, যেখানে ফাইন আর্ট, প্রথাগত শিল্প, লোকশিল্প মিলে সার্থক দেওয়া-নেওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়। শিল্পীদের থেকে কোনও ভাড়া পর্যন্ত নিইনি। আমরা শুধু সাহায্য করতে চেয়েছি তাঁদের।’
কেসিসি কর্তৃপক্ষ জানালেন, সামনের বছরগুলোতেও ধারাবাহিকভাবে এই উৎসবের আসর বসবে। তারই শুভসূচনা হল এ বার।