আজ কালী কথায় আমরা হানা দেব কালনায়, অতীতে নাম যার ছিল 'অম্বুয়া কল্যাণ'। বর্তমান নাম 'অম্বিকা কালনা'। কালনা শহরকে কালীময় বললে অত্যুক্তি হবে না। শহরজুড়ে রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী কালী, সাধন কালীর সাধন কুঞ্জ, আনন্দময়ী কালী, সিদ্ধান্ত কালী, সত্যনাথের কালী, সাধক যোগানন্দের কালী মন্দির। এছাড়াও কালনা শহরে রয়েছে সাধক কমলাকান্তের জন্মভিটে, ভবাপাগলার আশ্রম কি নেই।
কালী থেকেই শহরের নামকরণ কালনা হয়েছে কি না, তা নিয়ে কিংবদন্তি রয়েছে। শহরের নাম কালনা হলেও রেল স্টেশনের নাম অম্বিকা কালনা। আজ থেকে ৩০০ বছর আগেও এই জনপদ ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। একদা বর্ধমানের মহারাজা চিত্রসেন রায় ভাগীরথীর তীরবর্তী জঙ্গলপথ দিয়ে ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার কানে এল ঘন্টাধ্বনি। রাজা তা লক্ষ্য করেই ঢুকে পড়লেন জঙ্গলের আরও গভীরে। দেখলেন জনমানবহীন একটি প্রাচীন ভাঙা মন্দির এবং গর্ভগৃহে দেবী কালীকার সামনে সাজানো পুজোর নানা উপকরণ। রাজা ফিরে এলেন প্রাসাদে। ১৭৩৯ সালে প্রাচীন মন্দির সংস্কার করে নতুন মন্দির নির্মাণ করে দেবী অম্বিকার নিত্যপূজোর ব্যাবস্থা করলেন মহারাজা চিত্রসেন রায়।
বর্ধমানের প্রাচীন কালী পুজো গুলির মধ্যে অন্যতম অম্বিকা-কালনার সিদ্ধেশ্বরী কালী। সিদ্ধেশ্বরীকে সাধক অম্বরীশের আরাধ্য দেবী বলে মনে করা হয়। মনে করা হয়, জৈনদেবী অম্বুয়া বা অম্বিকাই পরে সিদ্ধেশ্বরীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। তাই অনুমান করা হয়, দেবী সিদ্ধেশ্বরী আদপে প্রাচীন জৈন দেবী অম্বিকারই পরিবর্তিত রূপ বলে মনে করা হয়। সেই দেবী অম্বিকার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই স্টেশনের নামকরণ অম্বিকা কালনা কি না, সেই মতও রয়েছে। সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দির ও মূর্তি শহরের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। চৈতন্যজীবনী কাব্যগুলোতেও প্রাচীন তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান হিসাবে অম্বিকার উল্লেখ রয়েছে। এই কালীমূর্তিকে প্রাচীন জৈন ও তন্ত্র সাধনার একটি বিশেষ দিকচিহ্ন বলে মনে করা হয়। এই মূর্তিকে ঘিরে তন্ত্র সাধনা বা গুহ্যসাধনার চর্চা ছিল।
মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন যোগী অন্মুঋষি। দেবীর মূর্তিটি প্রায় পাঁচ ফুট উচু। প্রাচীন দেবীমূর্তি নিম কাঠ দিয়ে তৈরি, দেবী এখানে বামাকালী মূর্তি৷ দেবীর পদতলে শায়িত শিব। দক্ষিণ দুই হস্তে বরাভয় মুদ্রা। দেবীর বামহস্তে আছে খড়্গ ও নরমুণ্ড। শিব এখানে শবরূপী৷ দেবীমূর্তি নিম কাঠ দিয়ে তৈরি হলেও শিবমূর্তি নিম কাঠের তৈরি নয়। দেবী মূর্তির সঙ্গে শিবমূর্তির সামঞ্জস্যও নেই। যা থেকে অনুমান করা হয় শিবের মূর্তি পরে স্থাপন করা হয়েছে। সিদ্ধেশ্বরী দেবী ভয়ঙ্করী রূপে দণ্ডায়মান, এই ভয়ঙ্কর দৃষ্টিকে তৎকালীন আর্থ সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক বলেই মনে করা হয়৷ আবার অনেকের মতে জ্ঞানমার্গ ও ভক্তিমার্গের মিলিত আঙ্গিককেই এমন রূপ বলে মনে করেন।
মূর্তিতে কোনও সূক্ষ্ম কাজ নেই, যা থেকে অনুমান করা হয় দারু শিল্পের একেবারে প্রথমাবস্থায় অর্থাৎ আনুমানিক ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীতে এই মূর্তি তৈরি হয়েছিল। সারা বছর দেবীকে দর্শন করা গেলেও শুধুমাত্র কোজাগরী পূর্ণিমার পরে কৃষ্ণা পঞ্চমী থেকে কৃষ্ণা ত্রয়োদশী পর্যন্ত দেবী দিগম্বরী বেশে থাকেন বলে ওই সময়ে মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। কার্তিক অমাবস্যায় সিদ্ধেশ্বরীর পুজো ঘিরে মেতে ওঠেন শহরের বাসিন্দারা। গর্ভমন্দিরে প্রসন্নময়ী দেবী চতুর্ভূজা বসন সজ্জিতা। করুণাঘন আকর্ণ ফালা ফালা চোখ। উচ্চতায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট। নিমকাঠের বিগ্রহ দেখলে মনে হয় কষ্টি-পাথরের। পদতলে শায়িত সুদর্শন মহাদেবের মাথা দেবীর বাম দিকে। বামহাতে তলোয়ার।
যোগী অম্বুঋষি প্রতিষ্ঠিত পঞ্চমুন্ডের আসনে প্রাচীন ঘটটি বিগ্রহের ডানদিকে। যোগীবরই প্রতিষ্ঠা করেন দেবীকে। অম্বু ঋষির নামানুসারেই দেবীর নাম হয় 'অম্বিকা'। 'কালনা' কথাটি এসেছে 'কল্যাণ' শব্দ থেকে। অম্বিকার বা অম্বুয়ার কল্যাণ থেকেই 'অম্বিকা কালনা'। বর্তমানে অধিকারী বংশ মায়ের সেবা কার্য্য সম্পাদন করে আসছেন। অধিকারীরা চট্টোপাধ্যায় বংশজাত হলেও দেবী অম্বিকাকে অধিকারে পাওয়ার জন্য এরা 'অধিকারী' উপাধি লাভ করেন।
কথিত আছে, অম্বরীশ ঋষি বর্তমান মন্দিরের অনতিদূরে পশ্চিমদিকে অম্বিকা-পুকুর নামে কথিত পুকুরের এক কোণে বটগাছের তলায় একটি ঘট পান। কুলো সমেত ঘটটি মন্দিরে রক্ষিত আজও আছে। জায়গাটি ছিল গভীর অরণ্যে পরিপূর্ণ। তিনি ওই ঘটকে বর্তমান মন্দির যে স্থানে অবস্থিত সেখানে বটগাছের তলায় প্রতিষ্ঠা করে সাধনা করেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন।
চারপাঁচ পুরুষ বংশ পরম্পরায় তারা সাধনা করে চলেছেন। ঈশ্বরীশ দেবীর স্বপ্নাদেশে মূর্তি তৈরি করান। নিমগাছের একটি কাষ্ঠখণ্ডেই মূর্তি তৈরি। ছোট বহরকুলির গাঙ্গুলীদের পুকুরপাড়ের যে তিনটি নিমগাছ ছিল তার মাঝেরটি দিয়ে কলকাতার নিমতলায় দারুশিল্পীকে দিয়ে মূর্তি গড়ে পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর বসানো হয়। এর পিছনে ছিল গঙ্গা ও শ্মশান। এককালে এখানে নরবলির প্রথা ছিল। প্রাচীন মূর্তিটি জীর্ণ হলে অম্বিকা-পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। বর্তমান মূর্তিটি এবং মন্দিরটি দ্বিতীয় সংস্করণ। রাজা চিত্রসেন প্রতিমা দর্শন করতে এলে মন্দির থেকে পাথরের চাঁই খসে পরে। রাজা মন্দিরটিকে সংস্কার করান। অনেকেই বলেন রাজা নতুন করে মন্দির নির্মাণ করান। ঈশ্বরীশের কোন শিষ্য ছিল না। স্বপ্নাদেশে তিনি সাতগাছিয়ার চাটুজ্জে বাড়ির একটি ছেলেকে নিয়ে আসেন। সেই ছেলেই ঠাকুর সেবার অধিকার পায়।
মন্দিরের কাছেই ছিল অম্বিকা পুকুর। আগে মন্দিরের নানা কাজে ওই পুকুরের জলই ব্যবহার করা হত। ওই পুকুরেই ছাগ স্নান করিয়ে মন্দিরে নিয়ে আসা হত বলির জন্য। পুকুরের জলের মধ্যে রাখা থাকত প্রচুর বাসনপত্র। গরিব মানুষ সেই বাসনপত্র বিয়ে বা অন্য কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করে, ফের জলের মধ্যে রেখে যেতেন।
বাংলার কুটির দেউল শিল্পের অন্যতম নিদর্শন এই দক্ষিণমুখী মন্দির। বেশ উঁচু ভিতের উপরেই অবস্থিত মন্দির, ভাগীরথীর বন্যা থেকে রক্ষা পেতেই এমনটা করা হয়েছিল। বাংলার দোচালা খড়ের ঘরের ধাঁচে তৈরি মন্দির জোড়াবাংলার মতো। মন্দিরের গায়ে রয়েছে পোড়ামাটির কাজ। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নগর সংকীর্তনের চিত্র৷ অনেক সিঁড়ি ভেঙে গর্ভমন্দিরে উঠতে হয়। মূল মন্দিরের পাশেই পরস্পর তিনটি শিবমন্দির এখনও অক্ষত। পোড়ামাটির সুদৃশ্য কারুমন্ডিত দেবী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে শিলা লিপির কথায় -
"শুভমস্ত শকাব্দা ১৬৬১/২/২৬/৬ শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবী শ্রীযুক্ত মহারাজা চিত্রসেন রায়না । মিস্ত্রি শ্রীরামচন্দ্র।"
মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত পাঁচটি শিব মন্দির।মন্দিরের পূর্ব দিকে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে চারটি শিবমন্দির। এদের মধ্যে তিনটি আটচালা মন্দির। এদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৬৮ শকাব্দে অর্থাৎ ১৭৪৬ সালে, প্রতিষ্ঠা করেন তিলকচন্দ্রের অমাত্য রামদেব নাগ। তিলকচন্দ্রের মা লক্ষ্মীকুমারী দেবীও ১৬৮৫ শকাব্দে অর্থাৎ ১৭৬৩ সালে একটি শিবমন্দিরটি নির্মাণ করেন।
দেবী অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরীর বাৎসরিক পুজো হয় কালী পুজোর সময় দীপান্বিতা অমাবস্যায়। এছাড়াও পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া, বিপদতারিনী ব্রত, শিবরাত্রি, দুর্গাপুজোর চারদিন, শনি ও মঙ্গলবার এবং অমাবস্যায় তিলধারণের জায়গা থাকে না মন্দিরে। দেবীর নিত্য অন্নভোগ দেওয়া হয়। এখানে অন্নের সঙ্গে প্রতিদিন মাছ ভোগ দেওয়ার নিয়ম। বাৎসরিক পুজোয় চিংড়ি এবং ইলিশমাছ ভোগ দেওয়ার রেওয়াজ।