শহর চেনা যায় তার বাজার দিয়ে। শহর যেভাবে বদলায় সেভাবেই বদলায় বাজারের চালচিত্র। শহরের জ্যান্ত দলিল আসলে তার বাজারগুলো। তত্ত্ব-তথ্যের বাইরে গিয়ে নিখাদ ‘বাজার ভ্রমণ’ আসলে বিশ্ব দর্শনের স্বাদ দেয়। কলকাতা শহরটাও তেমনি বাজার পরিবেষ্টিত এক শহর। শহর কলকাতার কসমোপলিটন চরিত্রের আঁচ পাওয়া যায় এখানকার বাজারগুলোতেও। রূপে-রঙে-গন্ধে-বর্ণে সে এক আশ্চর্য দেখা। পাঞ্জাব, সিন্ধু, উৎকল, মারাঠা বঙ্গ এক হয়ে যায়। শোরগোল-হাঁকডাকে জীবনের উচ্ছ্বাস! শহরের ‘প্রান’... সেরকমই কিছু বাজারের চালচিত্র মেলে ধরলাম এখানে।
হাওড়া ফুল বাজার- গঙ্গার ধারে হাওড়া ব্রিজের তলায় এশিয়ার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে পুরনো ফুলের বাজার। মল্লিক ঘাট ফুল বাজার। ১৮৫৫ সালে রামমোহন মল্লিক এই বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় দু হাজারেরও বেশি ব্যবসায়ী। দুর্গাপুজো, কালীপুজোর মত বড় উৎসব হলে বাজারের আয়তন আরও বেড়ে যায়। এই বাজার থেকে ফুল ইউরোপেও রফতানি করা হয়। বিখ্যাত এই বাজারটি দেখতে যেতে হলে আদর্শ সময় শীতকালের ভোরবেলা।
নিউমার্কেট- নিউ মার্কেট। বাঙালির বড় আদরের জায়গা। বলা হয় খুঁজলে নাকি বাঘের দুধও পাওয়া যেত নিউমার্কেটে। কাঁচা আনাজ থেকে শুরু করে ব্র্যান্ডেড বিদেশি জিনিস সব মেলে এখানে। একটা সময় সরকারী কাজ আর ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য প্রচুর ইংরেজ বাস করত কলকাতায়। কিন্তু তাঁদের দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্য সেরকম কোনও বাজার ছিল না। স্টুয়ার্ড হগ সাহেব তখন কলকাতা শহরের কমিশনার। তাঁর উদ্যোগেই ধর্মতলা পার্কস্ট্রিট অঞ্চলে শুরু হল বাজার তৈরির পরিকল্পনা। মার্কেট তৈরির জন্য জমির দাম বাবদ ২ লক্ষ টাকা এবং নির্মাণের খরচ বাবদ ২.৫ লক্ষ টাকা লগ্নি করা হয়। নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হল ম্যাকিনটোশ বার্ন কোম্পানিকে। রিচার্ড বেইন ছিলেন সেসময়ের নাম করা স্থপতি। তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হল বাজারের নকশা তৈরির। ব্রিটেনের রেল স্টেশনের আদলে তৈরি এই বাজারে ৭ টি ভাগ রয়েছে। ১৮৭৩ সালে শেষ হয় নির্মাণ কাজ।
নতুন বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৮৭৪ এর ১ জানুয়ারি খুলে দেওয়া হয় নিউ মার্কেট। হগ সাহেবের নামে নাম রাখা হয় 'স্যার স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট'। লোকমুখে যা ‘হগ সাহেবের বাজার’। পরে নাম হয় ‘নিউ মার্কেট’। তবে মূল ভবনে আজও জ্বলজ্বল করে হগ সাহেবের নাম।
বড় বাজার- ‘বড় বাজার’। নাম বলে দেয় বাজারের চরিত্র। প্রায় ২০০ বছরের বেশি পুরনো। দেশের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার। হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে মহাত্মা গান্ধী রোডে ঢুকলেই পা পড়বে বড় বাজারে। হাতে টানা গাড়ি আর ভারি বোঝা মাথায় মানুষগুলোর হাঁক-ডাক বুঝিয়ে দেবে ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছেন। মহাত্মা গান্ধী রোডের মুখ থেকে পর্যন্ত পুরোটাই বাজার অঞ্চল। হাজার এক গলি, চুলের মত সরু সরু অজস্র গলি, তস্য গলির অন্দরে আড়ত, গুদাম, দোকান ঘর। আধো অন্ধকার বাড়িগুলো বাইরে থেকে দেখলে আন্দাজ করা মুশকিল তার ভিতরের কোন খনি লুকিয়ে আছে। সুতোপট্টি, তুলো পট্টি, ফ্যান্সি পট্টি, চিনি পট্টি, চুনপট্টি এরকম অসংখ্য নাম।
লেক মার্কেট- কালীঘাট মেট্রো স্টেশন থেকে রাসবিহারীর মোড়ের দিকে এগোলে লেক মার্কেট। কলকাতার সেরা বাজারগুলোর একটি। দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলটিতে দক্ষিণ ভারতীয় সম্প্রদায়ের মানুষের বাস বেশি ছিল এক সময়। তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাজার গড়ে ওঠে। বাজারে ঘুরলে দক্ষিণী সম্প্রদায়ের প্রভাব বোঝা যায়। রোস্টেড কফি বিন, ব্যানানা চিপ্স, রসম মশলা, সম্বর পাউডার, মুরুক্কু, পাপাড়ম, দক্ষিণী মশলা পাওয়া যায় এই বাজারে। কলকাতা শহরের আর কোনও বাজারে এভাবে দক্ষিণী ফ্লেভার পাওয়া যায় না। কালীঘাট মেট্রো থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে রাসবিহারীর দিকে এগোলেই দু’পাশের ফুটপাতে ইডলি, দোসা, উত্তাপম, বড়া স্টল চোখ টেনে নেবে। লেক মার্কেট বিখ্যাত তার মাছ আর ফুলের জন্য।
গড়িয়া হাট মার্কেট- ‘হাট’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘সাপ্তাহিক বাজার’। এখনকার গড়িয়াহাট বাজার দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এক সময় দক্ষিণের এই বাজারটিও ‘হাট’ শ্রেণীভুক্ত ছিল। সেই সূত্রেই গড়িয়া হাট। দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র। গড়িয়া হাট রোড এবং গোলপার্কের দক্ষিণে গমগমে এক বাজার। বিখ্যাত সব শাড়ির দোকান আর ঝাঁ চকচকে মল। চোখ টেনে নেওয়া গ্ল্যামার। সে সব থাকলেও গড়িয়া হাটের আকর্ষণ তার ফুটপাত। কী নেই সেখানে? বিছানা, বালিশ, বাসন থেকে শুরু করে ঘর বা বাড়ির প্রয়োজনীয় এমন কিছু জিনিস নেই যা এখানে পাওয়া যাবে না। জামা-কাপড়, জুতো, জুয়েলারি, ব্যাগ থেকে শুরু করে সেকেন্ড হ্যান্ড বই পর্যন্ত! দরাদরি কষাকষিতে আপনি যতটা পোক্ত হবেন ততটাই লাভ।
ফুটপাত ধরে হেঁটে গেলে পরপর সার দিয়ে মেহেন্দির স্টল। ছোট-ছোট টুলে বসে হাতে নিপুণ রেখার টান। আর অবশ্যই ঝালমুড়ি, ফুচকা, মোমো আর আচার। বেশ কিছু নামকরা ‘রোল’ এর দোকান আছে গড়িয়াহাট বাজারে। যেগুলোর স্বাদ না নিলে গড়িয়াহাট ‘ভ্রমণ’ বৃথা।
কলেজ স্ট্রিট – বইপ্রেমি মানুষের স্বর্গ। মধ্য-কলকাতার গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ আর মহাত্মা গান্ধী রোডের সংযোগ স্থলে বইপাড়া। নতুন বই তো বটেই, পুরনো বইয়ের স্বর্ণখনি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের মার্কেট। বাংলার প্রায় সমস্ত বড় প্রকাশনা সংস্থার দফতর কলেজ স্ট্রিটে।
কলেজ স্ট্রিটের প্রথম বইয়ের দোকানের মালিক ছিলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। এরপর ১৮৮৩ সালে গড়ে উঠল এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড কোম্পানি, ১৮৮৬ সালে দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও একটা বইয়ের দোকান খুলেছিলেন এই অঞ্চলে, নাম সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি। তার ধীরে ধীরে আজকের চেহারা নিয়েছে।
হাতিবাগান- হাতিবাগান" নামটির উৎপত্তি নিয়ে দু'টি মত প্রচলিত আছে। একটি মত অনুসারে, ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ করার সময় নবাব সিরাজদ্দৌলার হাতিগুলিকে এখানে রাখা হয়েছিল। অন্য মতে, এই অঞ্চলে "হাতি" পদবীধারী জনৈক ব্যক্তির একটি বাগানবাড়ি ছিল। মেহতাব চাঁদ মল্লিক পরে সেই বাগানবাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, এই মেহতাব চাঁদ মল্লিকই হাতিবাগান বাজারটি প্রতিষ্ঠা করেন। হাতি বাগান এক সময়ের থিয়েটার পাড়া। থিয়েটার আর সিনেমা হলগুলো এই অঞ্চলের সিগনেচার ছিল। হাতিবাগান বিখ্যাত শাড়ির দকানের জন্য। মধ্যবিত্তের বিনোদন ছিল ‘বিকেল বেলার হাতিবাগান’।
হাতিবাগানের শতাব্দীপ্রাচীন বাজারটি বাংলার রেশম ও তাঁতের শাড়ির জন্য বিখ্যাত। ২০১২ সালের ২২ মার্চ একটি অগ্নিকাণ্ডে এই বাজারের একটি বড়ো অংশ পুড়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপানি বিমানবাহিনী হাতিবাগানে বোমা ফেলেছিল।
বউ বাজার- বউ বাজার। ‘বহু’ বাজার থেকে অপভ্রংশে ‘বৌ’। যদিও অনেকে বলেন, বিশ্বনাথ মতিলাল পুত্রবধূর নামে এই বাজারের পরিচিতি। তাই বৌ বাজার। ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত টানা সোনার দোকান। এটিই কলকাতার প্রধান গয়নার বাজার। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয়। প্রথম ট্রামের যাত্রা পথটি ছিল আর্মেনিয়ান ঘাট থেকে বউবাজার ও ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত।
কোলে মার্কেট- কলকাতার দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল স্টেশন শিয়ালদহ’র পাশেই কোলে মার্কেট। মধ্য কলকাতায় অবস্থিত। কলকাতার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। অনেকে কোলে মার্কেটকে বড় বাজারের প্রসারিত অংশ বলে মনে করেন। কলকাতার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। সম্ভবত পূর্ব- ভারতের মধ্যেও সব চেয়ে বড়। সবজি, মাছ, দুধ, পোলট্রি পণ্য পাওয়া যায়। বছরের ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা বাজার খোলা থাকে।
যদুবাবুর বাজার- দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে ‘যদু বাবুর বাজার’। লোক মুখে ‘জগু বাবু’। 'যদুবাবু বাজার' নামকরণ হয় রাণী রাসমনির পৌত্রের নামানুসারে।এই অঞ্চলে তাঁর কর্তৃত্ব বজায় ছিল। লেক মার্কেটে যদি দক্ষিণী বৈশিষ্ট নজর কাড়ে, যদুবাবুর বাজারে উত্তর। পাঞ্জাবি আচার, সর্ষোঁ দা সাগ মেলে। এই বাজারে মাছ ফলের পসার চোখে পড়ার মতো।