পৃথিবীর এক বিস্ময়কর সৌন্দর্য হলো - অরোরা। আরো সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে মেরু অঞ্চলের রাতের আকাশে নানা ধরণের আলোর প্রদর্শনী দেখা যায় , সেটাই অরোরা নামে পরিচিত , যদিও বাংলায় তার পরিচিতি একটু ভিন্ন নামে, নামটির সাথে সবারই পরিচিতি আছে , আর তা হলো - মেরুজ্যোতি । পৃথিবীর দুই চৌম্বকীয় মেরুতে এই অসাধারণ , অবর্ণনীয় আলোক সৌন্দর্য দেখা যায়। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে সৃষ্ট অরোরা আবার দুটি ভিন্ন নামে পরিচিত - যেমন উত্তরে নর্দান লাইটস বা অরোরা বোরিয়ালিস এবং দক্ষিণে অরোরা অস্ট্রালিস বা সাদার্ন লাইটস লাইটস। কিন্তু এই প্রাকৃতিক আলোক মালা সৃষ্টির কারণ কি , আর তা প্রত্যক্ষ করার মাধ্যম কি - আর তাতেই সম্প্রতি ছায়া পড়েছে করোনার - কিভাবে ! এই সব সম্পর্কে জানবো আজ।
পৃথীবীর কিছু অদৃশ্য চৌম্বকীয় ক্ষেত্র আছে , যা সৌরজগতের বিভিন্ন ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয়তা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। সূর্য থেকে আসা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অনু - পরমাণু সমন্বিত সোলার উইন্ড বা সূর্য বায়ু পৃথিবীকে অতিক্রম করছে। এই সৌরবায়ু যখন পৃথিবীর কাছাকাছি আসে তখন পৃথিবীর দুই মেরু এসব পরমাণুকে চৌম্বকীয় বলে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে টেনে আনে। সূর্য থেকে আসা পরমাণু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গ্যাসের অণুপরমাণুর সাথে বিক্রিয়া করে , আর সেই বিক্রিয়ার ফলেই বিভিন্ন রঙের সৃষ্টি হয়। আরো একটু স্পষ্ট করে বললে অরোরা মূলত সৌরবায়ুর সাথে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়। বিক্রিয়ার ধরণ ও পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন রঙের আলো দেখা যায়। পরমাণু মূলত নীল রং উৎপন্ন করে আবার দুইটি নাইট্রোজেন পরমাণু একত্রে বিক্রিয়া করলে বেগুনি রং উৎপন্ন হয়। এছাড়া উচ্চতার উপরও রঙের পার্থক্য দেখা যায়।
ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় অক্সিজেন পরমাণু সবুজ রং নিঃসরণ করে। আর এই বিক্রিয়া যদি ২৪০ কিলোমিটার উচ্চতায় সম্পন্ন হয় তখন অক্সিজেন পরমাণু থেকে লালচে রঙের আলো দেখা যায়। আর যখন এই সব রং একে ওপরের সাথে মিশে যায় তখই নতুন নতুন ভিন্ন রঙের বর্ণচ্ছটা তৈরী হয়। মধ্যযুগের বিজ্ঞানী গ্যালিলিও মনে করতেন পৃথিবীতে সূর্যের আলো প্রতিফলনের কারণে অরোরা দেখা যায়। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নরওয়ের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান বার্কল্যান্ড সর্ব প্রথম প্রমান করেন বায়ুমণ্ডলের পরমাণু অরোরা সৃষ্টির জন্য দায়ী। খ্রিস্টপূর্ব ৩০ হাজার বছর আগে একটি গুহা চিত্রে মানুষের অরোরা পর্যবেক্ষণের প্রমান পাওয়া যায়। তবে প্রাচীন কালে অরোরার সর্ব নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া গেছে ২৬০০ বছর আগের এক চীনা পাণ্ডুলিপিতে। সেখানে অরোরা কে তীব্র বজ্রপাতের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আবার অতীতে কিছু কুসংস্কারও প্রচলিত ছিল। মানুষ মনে করতো তাদের পূর্বপুরুষেরা আকাশে নাচানাচি করার ফলে এমন আলোর খেলা দেখা যায়। যে সৌরবায়ু এই অরোরা সৃষ্টির জন্য দায়ী তা আবার একই সাথে বেশ কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে। এইসব ধনাত্মক আধানযুক্ত পরমাণু স্যাটেলাইট যোগাযোগের জন্য বাধা সৃষ্টি করে। ফলে রেডিও , নেভিগেশনে মারাত্মক সমস্যা দেখা যায় । এমনকি কখনো এইসব সৌর বায়ু বৈদ্যুতিক ঢেউ সৃষ্টি করে। যা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিঘ্ন ঘটাতে সক্ষম। পৃথিবীর মাঝবরারবর তীব্র চৌম্বকীয় আকর্ষণ না থাকার কারণে শুধু উত্তর ও দক্ষিণ মেরুকে কেন্দ্র করে অরোরা সৃষ্টি ,তাই দুই মেরুর প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার জুড়ে এই আলোর প্রদর্শিনীও দেখা যায়। তবে এই অঞ্চলের বাইরের অনেক দূর পর্যন্ত অরোরার সাক্ষাৎ মিলতে ও পারে। এর সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করতে মার্চ ও সেপ্টেম্বর মাস সবথেকে বেশি কার্যকরী । অরোরা পর্যবেক্ষণে সবথেকে জনপ্রিয় অঞ্চলগুলি হলো - আইসল্যান্ড, কানাডা ও আলাস্কা।এর উল্লেখযোগ্য জায়গার মধ্যেই আছে আইসল্যান্ডের কির্কযুফেল পর্বত এবং বুবেল লজ, কানাডার ইয়েলো নাইফ , উড বাফেলো ও জেসপার ন্যাশনাল পার্ক এবংআলাস্কার ফেয়ারব্যাংকস। এইসব জায়গাগুলো অরোরার জন্য পর্যটক সমন্বিত থাকে। এছাড়াও মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি এই অরোরা দেখা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বিশ্বব্যাপী মারণ ভাইরাস করোনার আক্রমণে সর্বত্র যাত্রা নিয়ন্ত্রিত। সুস্থতা রক্ষায় এই নিয়ন্ত্রন মানতে বাধ্য। তাই ভাটা পড়েছে অরোরার সৌন্দর্য দেখার পর্যটনকেন্দ্র গুলোতে । যদিও তা সাময়িক। তাই ইচ্ছে আর রেস্ত থাকলে দেখে আসতেই পারেন প্রাকৃতিক আলোর খেলা – মন্দ লাগবে না।